আজ, রবিবার | ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | সকাল ৬:৩৩

ব্রেকিং নিউজ :

পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ হতেই পারে না-সঞ্জয় কুমার দত্ত

সঞ্জয় কুমার দত্ত : ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ হতেই পারে না। বাংলা নামটি কেবল আমাদেরই।

এ বছরের ২৬ জুলাই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যকে সরকারিভাবে ‘বাংলা’ নামে পরিচিত করার প্রস্তাব রাজ্যটির বিধানসভায় সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়েছে। নিরাপদ সড়ক চাই শিক্ষার্থী আন্দোলন বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে একটি আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ সংঘটিত। অর্থাত্ যে সময় আমাদের অস্তিত্বের জন্য প্রতিবাদ প্রয়োজন সেই সময় একটি অনাকাঙিক্ষত ঘটনা এই নাম পরিবর্তনের বিষয় থেকে চোখ ফিরিয়ে দেয় !!!

বঙ্গ বিভাজনের পর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কি নামকরণ হবে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নানা লেখায় “বাংলা” এবং “বঙ্গ” দুটি শব্দই ব্যবহার করেছেন। সেই ব্যবহার বঙ্গের অতীত ইতিহাসের থেকে কাব্যের প্রয়োজনে বেশী ছিল। ভাষাতাত্ত্বিকেরা “বাংলা” নামটি প্রত্যাহার করেন। প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক এবং জাতীয় শিক্ষক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেন; ‘পশ্চিম বঙ্গ’ (ওয়েস্ট বেঙ্গল) বলিলেই সঙ্গে সঙ্গে তাহার জবাব-রূপে ‘পূর্ব বঙ্গ’ (বা ইস্ট বেঙ্গল) নামটিও আপনা হইতেই আসিবে। সমগ্র ‘বঙ্গদেশ’ সমন্ধে এই ঐক্যবোধকে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্যই, বঙ্গীয়-সাহিত্য পরিষদ হইতে প্রতিবাদ করা হইয়াছিল-মাঝে যে প্রস্তাব উঠিয়াছিল যে ‘পশ্চিম বঙ্গ’ (ওয়েস্ট বেঙ্গল) নামটিকে বর্জন করিয়া তাহার স্থানে কেবল ‘বঙ্গদেশ’ বা বাঙ্গালা দেশ (বেঙ্গল) বলা হউক, ভারত-সরকারও এই নাম গ্রহণ করুক, তাহা অনুচিত, অযৌক্তিক ও অনৈতিহাসিক, এবং দেশাত্ববোধের পরিপন্থী। অতএব এই প্রস্তাব পরিত্যক্ত হউক। সুখের বিষয়, পশ্চিম বঙ্গ নামটিকে বিতাড়িত করিবার প্রস্তাবটি সমন্ধে এই আপত্তি উঠায়, ইহা গৃহীত হয় নাই (সুনীতিকুমার চট্রোপাধ্যায়:গৌড় বঙ্গ, বঙ্গদর্পনে সংকলিত-পৃষ্ঠা ৬৭)।

২০১৭ সালের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ‘বাংলা’ করার ইচ্ছায় পানি ঢেলে দিয়েছিল দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কারণ ওই নামে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে মিল থাকায় কূটনৈতিক জটিলতা দেখা দিতে পারে মনে করছেন দু’দেশের বিশ্লেষকেরা। দেশটির পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পশ্চিমবঙ্গের সচিবালয় নবান্নে পাঠানো এক চিঠিতে এই বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ করা হলে বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। এই কারণ দেখিয়েই ‘বাংলা’ নামে আপত্তি তুলেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইছে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ইংরেজি, বাংলা এবং হিন্দি সব ভাষাতেই রাজ্যের নাম একটি রাখা হোক।

এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমি’র মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেছিলেন, “কিছুটা দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। তবে আমাদের বাংলার সঙ্গে দেশ রয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “আসলে বাংলা বলতে বর্তমান বাংলাদেশকে বোঝায়। বিশেষ করে ঢাকা, ফরিদপুর, কুমিল্লা এসব অঞ্চলই ছিল বাংলা অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গ পরিচিত ছিল রাঢ় বা সৌম্য নামে।”

এদিকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, “আমি বঙ্গ নাম প্রস্তাব করেছিলাম। শুনেছিলাম মুখ্যমন্ত্রী তা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু বাংলা নাম গৃহীত হওয়ায় বিভ্রান্তিই তৈরি করবে প্রতিবেশী দেশের নামের সঙ্গে।” তিনি আরও বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার এই বিভ্রান্তি তৈরির সম্ভাবনার কারণেই অনুমোদন দেবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।”

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই পশ্চিমবঙ্গ বা ওয়েস্ট বেঙ্গল নামটি তাৎপর্যহীন হয়ে পড়েছিল। তাহলে শুধু শুধু বাংলার সঙ্গে পশ্চিম বহন করা কেনো। এই মত সবকটি রাজনৈতিক দলসহ বুদ্ধিজীবীদের। বাংলা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নতুন পরিবর্তিত নাম। এতে সমর্থন দিয়েছে বিরোধী দল কংগ্রেস ও বামপন্থীরা। ভারত সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি না পেলেও পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলা রাজ্যের বিধানসভায় এই নাম পরিবর্তনের আইন পাস করা হয়।

ওপারে বাংলাদেশ আর এই পারে বাংলা। কেন্দ্রীয়ভাবে বিষয়টি অনুমোদন পেলে এরপর সব ভাষাতেই পশ্চিমবঙ্গের নতুন পরিচয় হবে ‘বাংলা’। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার উদ্যোগী হলেও একসময় তিনিই তিন ভাষায় তিন রকম নামের প্রস্তাব করেছিলেন।

২০১৪ সালে সরকার একই যুক্তিতে নাম পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করেছিল সরকার তবে তা সফল হয়নি। এই বারে একমাত্র বিজেপি নাম পরিবর্তনের বিরোধীতা করেছে। তাই সব কিছু ঠিক থাকলে পশ্চিমবঙ্গ তার নতুন নাম পাওয়ার প্রথম পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে।

এর আগে ২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট রাজ্য বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গ নামের পরিবর্তন এনে তিনটি ভাষায় তিনটি নামের প্রস্তাব পাশ হয়। ওই তিন ভাষায় মধ্যে, বাংলাতে রাজ্যের নামের প্রস্তাব করা হয়েছিল ‘বাংলা’। হিন্দিতে ‘বাঙাল’ আর ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ নাম প্রস্তাব পাশ হয়েছিল।

কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের ঐ নাম পরিবর্তনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীসভায় খারিজ হয়ে যায়। বলা হয়, একক নাম নির্ধারণ না করলে নাম পরিবর্তন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তারা বেশ কিছু পরামর্শও দেয়।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য:
প্রস্তাবের পক্ষে বলতে গিয়ে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেন, ‘বাংলা নামটা বাংলার রক্তের সঙ্গে। বাংলা নামটা বাংলার মা-মাটি-মানুষের সঙ্গে। বাংলা নামটা বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার সভ্যতা, বাংলার হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, বাংলার সব ভাষা-জাতি-ধর্ম-বর্ণের সঙ্গে। রাজ্য বাংলা হিসেবে মর্যাদা পাক, বিশ্ব বাংলায় পরিগণিত হোক।

তিনি বলেন, ভাষার দিক থেকে পৃথিবীতে পঞ্চম বৃহত্তম বাংলা। এটা আমাদের গর্ব। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন অনেক তরুণ আর এই ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কত তরুণকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলায় হবে বাংলা, ইংরেজিতে বেঙ্গল এবং হিন্দিতে বঙ্গাল। কিন্তু কেন্দ্র সরকার চাইছে একটি মাত্র নাম। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাবের নিজস্ব ভাষা আছে। আমাদেরও নিজস্ব ভাষা আছে। সব রাজ্যের রানি বাংলা।’ কণ্ঠভোটে বিধানসভায় পাস হয় রাজ্যের নাম বাংলা করার প্রস্তাব। বিরোধীরা বাংলা নাম বদলের প্রস্তাব সমর্থন করে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিজেপির ভূমিকা:
পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা করে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠিকে স্মারকলিপি দেয় রাজ্য BJP। স্মারকলিপিতে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। লেখা আছে, বিধানসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে বাংলা করা হবে। আমরা এর বিরোধিতা করছি। কারণ এর আগে বহুবার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ইংরেজিতে ওয়েস্টবেঙ্গল নাম হওয়ায় সংসদে সবার শেষে বলতে ওঠেন রাজ্যের সাংসদরা। এর আগে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালীন তারাও রাজ্যের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছিল। দিলীপবাবু জানান, বেশ কয়েকটি রাজ্যের নাম আলফাবেটিকালি অর্ডারে প্রথমদিকে থাকলেও তারা শেষে বলতে ওঠে। তাই, এর জন্য রাজ্যের নাম পরিবর্তনের কোনও কারণ নেই।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বামফ্রন্টের ভূমিকা:
বাম জমানার নাম বদলের দাবি জোরদার হলে তত্‍কালীন সরকার সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ রাখার প্রস্তাব করে৷ কিন্ত্ত কেন্দ্রের বিদেশমন্ত্রকের আপত্তিতে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেয় দিল্লি৷ তারা জানায় বাংলা নামে ব্যাংক-সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি সমস্যায় পড়বে৷ বিদেশে লেনদেন ও বাণিজ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে বাংলা গুলিয়ে যেতে পারে৷ সুজন বাবু সাংবাদিক দের জানান, ১৯৯৯ সালে আমাদের কথা শোনেন নি বিজেপি এবং NDA জোটে থাকা তৃণমূল, আর আজ আমাদের প্রস্তাবই মানতে হল তৃণমূল এবং বিজেপিকে। ১৯৯৯ সালের বামেদের দেখানো পথেই পাল্টালো বাংলার ভবিষ্যৎ। এবার থেকে পশ্চিম বাংলার পরিবর্তে ‘বাংলা’ নামেই ডাকা হবে আমাদের মাতৃভূমি কে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য কংগ্রেসের ভূমিকা:
বিধানসভায় বিরোধী কংগ্রেস বিধায়করা বলেন, ‘বাংলায় বসবাস করি। বাংলা ভাষায় কথা বলি। তাই রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা করা অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। এতে রাজ্যবাসী লাভবান হবে। পশ্চিমবঙ্গ আরও এগিয়ে যাবে।’

এর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তসলিমা লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে গেল। কী দরকার ছিল নাম বদলাবার? যুক্তি যা দেওয়া হয়েছে, সবই হাস্যকর। সর্ব ভারতীয় সভায় নাকি ওয়েস্ট বেঙ্গলের আদ্যাক্ষরের কারণে ডাক পড়ে শেষে, আর সভার শেষ দিকে কারোর আর বক্তৃতা শোনার আগ্রহ থাকে না, সবাই ঘুমিয়ে পড়ে অথবা বাড়ি চলে যায়। আদ্যাক্ষর A হলেই যদি লাভ হতো, তাহলে অরুণাচল প্রদেশ সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ রাজ্য হয়ে যেত ভারতবর্ষের। এতই যদি ডব্লুতে আপত্তি, তবে পশ্চিমবঙ্গের P নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা যেত।

‘পশ্চিমবঙ্গ নামটি অন্যরকম। এই নামের ভেতর লুকিয়ে আছে লক্ষ মানুষের বেদনার ইতিহাস। পশ্চিম আছে, পূর্ব নেই। পূর্ব বংগের নাম থেকে শুরু করে চেহারা চরিত্র সব পালটে গেছে অখন্ড ভারতবর্ষকে যখন ধর্ম এসে ধর্ষণ করেছিল। ‘

‘পশ্চিমবঙ্গ নামটির সংগে পূর্ববঙ্গের না থাকাটা থেকে যায়। থেকে যায় ঘৃণা আর বিদ্বেষের খুনোখুনিতে মানুষকে লেলিয়ে দেওয়া আর , ধর্মের কাঁটাতার দিয়ে দেশ ভাগ করার রাজনীতি, থেকে যায় মা আর মাটি থেকে মানুষকে উচ্ছেদ করার গল্প, থেকে যায় স্বজন রেখে স্বজনের নিরুদ্দেশ যাত্রা, থেকে যায় আপামর বাঙালির মর্মান্তিক ইতিহাস। ‘

পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের পিছনের যুক্তি :
ইংরেজিতে রাজ্যের নাম লেখা হয় ওয়েস্ট বেঙ্গল। ইংরেজি বর্ণমালা (W) অনুযায়ী শেষে থাকায় সাংবিধানিক সংস্থার সঙ্গে রাজ্যের যে কোনো আলোচনায় বক্তব্য পেশের জন্য রাজ্যের প্রতিনিধিদের শেষের দিকে বলার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সদস্যদের বক্তব্য শোনার ধৈর্য আর থাকে না।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন “এই তুচ্ছ যুক্তি দিয়ে রাজ্যের নাম পরিবর্তনের কোনো অর্থ নেই”।

ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বেনারকে বলেন, “দেশভাগের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হিসেবে এই নাম পরিবর্তন করার চেষ্টা হচ্ছে।” তিনি মনে করেন, “কেন্দ্রীয় সরকার এই নাম পরিবর্তনে অনুমতি দেবে না।”

প্রবীণ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য্য অবশ্য রাজ্যের নাম পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “একসময় এই অঞ্চল বাংলা নামেই পরিচিত ছিল। রবীন্দ্রনাথও তার লেখায় বাংলা নাম ব্যবহার করেছেন। বহু আগে থেকে এই বাংলা নাম চলে আসায় রাজ্যের নাম বাংলা রাখায় কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।”

বাংলাদেশের তরুণ সাহিত্যিক খালিদ মারুফের মতে, এটা সোভিনিজমের প্রকাশ। তিনি বলেন, “প্রতিবেশী দেশের নাম থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলা রাখাটা এখন এক পক্ষ সোভিনিজম বা উগ্র জাতীয়তাবাদ বলতেই পারে। সেটা বলার সুযোগ তৈরি হলো আর কি!”

আসল কারণ মমতার দূরভীসন্ধি:
ওয়েস্ট বেঙ্গল নামের জেরে সমস্যার পড়তে হয়েছে মমতা ব্যানার্জিকেও। কিছুদিন আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে আন্তরাজ্য পরিষদের বৈঠক টানা ছয় ঘন্টা বসে থাকতে হয় মমতাকে। রাজ্যের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে নাম ডাকার ফলে একদম শেষ বলার সুযোগ পান মমতা। কারণ পশ্চিমবঙ্গ বা ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম ছিল সবার শেষে। তাও মাত্র বারো মিনিট। এ কারণেই বৈঠক থেকে বেরিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন মমতা। ঐ বৈঠকৈ তিনি রাজ্যের অনেক সমস্যা তুলে ধরার জন্য পাকাপোক্ত ভাবে গিয়েছিলেন কিন্তু সময়ের কারনে কিছুই বলতে দেওয়া হয়নি। এরপরই তিনি ঠিক করেন যে আর শেষে নয়, এবার কেন্দ্রের কাছে দাবি জানাতে হবে নাম বদলের, যাতে করে রাজ্যের নাম আরও ওপরের দিকে চলে আসে।

মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে বাংলা নাম রাখার পক্ষে যে যুক্তি দেখিয়ে আগে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ নেওয়ার কথা ভাবছেন, সে সুযোগে অন্য একটি রাজ্য পেছনে চলে যাবে। কখনো সে রাজ্যটিও যদি ভবিষ্যতে আগে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য এমনি খোঁড়া যুক্তি দিয়ে নাম পাল্টানোর উদ্যোগ নেয়, তাহলে ভারতের কী হবে? অনেকে বলছেন, শুধু বাংলা নাম রাখলে দ্ব্যর্থক হবে। বাংলাকে যদি দেশনাম হিসেবে ধরা হয় তাহলেও সেটা অখণ্ড বাংলা (ভাষাভাষী) অঞ্চল অর্থে প্রতিষ্ঠিত। তাই অভিন্ন নামাঞ্চলের একটি খণ্ডিত অংশকে মূল ভূখণ্ডের‚ নাম প্রদান করা সমীচীন হবে না। ধরুন, কারো নাম সলিম। কোনো কারণে তার শরীর খণ্ডিত হয়ে গেল। একটি খণ্ডিত আঙুলের নাম সলিম রাখা হলে তা আসল ব্যক্তির প্রতি উপহাস করার তুল্য। তাহলে তার শরীরের অন্যান্য খণ্ডিত অংশও একই নাম দাবি করতে পারে। বাংলা নামটির ওপর বাংলাদেশ, এমনকি ত্রিপুরারও দাবি রয়েছে।

নাম পরিবর্তনের কারণ:
ভারতের ২৯টি রাজ্য সরকারের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের ইংরেজি নাম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ ইংরেজি ‘W’ দিয়ে শুরু হয়। তিনবারই নামবদলের সরকারি উদ্যোগের পেছনে মূল কারণ একটাই- দিল্লিতে আন্তঃরাজ্য বৈঠকে রাজ্যের প্রতিনিধিদের ডাক পড়ে ২৯ নম্বরে, যখন বৈঠক শেষের মুখে। আর এ কারণে রাজ্যের নাম একেবারে শেষের দিকে থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনার সময় মুখ্যমন্ত্রী শেষের দিকে কথা বলার সুযোগ পান বলে অভিযোগ এনে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ রাখার প্রস্তাব করেন মমতা।এ বার ইংরেজিতে নাম যদি `বেঙ্গল` হয়, রাজ্যের ডাক পড়বে অন্ধ্র, অরুণাচল আর অসমের পরেই, ৪ নম্বরে।

তবে রাজ্যের এই নাম পরিবর্তন নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।

অবশ্য এ প্রশ্নও উঠেছিল, বর্ণানুক্রমিক তালিকায় তো নিচের দিকে রয়েছে পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড বা উত্তরপ্রদেশ। তাদের কি উন্নয়ন কিছু কম হয়েছে? কেন্দ্র তাদের দাবি কম মেনেছে?

কেননা পশ্চিমবঙ্গ নামের এই রাজ্যে এক ধরনের নিচুমানের মদ পাওয়া যায়; যা বাংলা নামে পরিচত। দু-একজন বলতে চেয়েছেন, পানীয় ‘বাংলা’এর সঙ্গে মিলে যায় এমন নামটি না আনলেও চলত। কয়েক বছর আগের একটা হিসাবে দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গের মোট আবগারি শুল্ক বাবদ আয়ের ৩৯ শতাংশ আসে বাংলা মদ বিক্রি থেকে। পৃথিবীতে হয়তো এই একটাই উদাহরণ যে জনগোষ্ঠীর প্রাণের ভাষা বা দেশের নামের মতোই কিছুটা অবজ্ঞামিশ্রিত একটা পানীয়র নাম যুক্ত হয়েছে অভিন্ন বানানে। এই পানীয়র নাম রাজ্যটির নতুন প্রস্তাবিত নামকে অংশত হলেও হেয় করবে বলে অনেকে মনে করেন।

বাংলা’ নাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল রাজনৈতিক মহলে। কেউ কেউ বলেছিলেন, রাজ্যের নাম বাংলা হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যা হতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের স্লোগান হলো জয় বাংলা।

এই প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল ঠিকই আছে।পাশে বাংলাদেশ তো একটি আলাদা দেশ।
রাজ্যের নাম বাংলা হলে অসুবিধে কোথায়? পাকিস্তানেও পাঞ্জাব আছে, আমাদের দেশেও পাঞ্জাব আছে।’

পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের মন্তব্য:
বাংলা নাম নিয়ে আইনসভার এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে কবি জয় গোস্বামী। শঙ্খ বলেন, ‘ভালোই হল, সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ, এপারে বাংলা। দুই পাশের মানুষই একই ভাষায় কথা বলেন, একই কবির গান গেয়ে থাকেন, একই মাতৃভষায় আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। আমরা বাংলা চেয়েছিলাম, বাংলাই হল।’ গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা হলেও এদিন আইনি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।

পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা” রাখার বিপক্ষে সেই দেশের অনেক গুনি মানুষই :
বুদ্ধদেব গুহ:
আমি সাজেস্ট করছি নামটাকে বঙ্গভূমি রাখার জন্য। বঙ্গ নামটা কেমন ন্যাংটো ন্যাংটো শোনায়। বাংলা নামটাও ভালো শোনায় না। সুতরাং বঙ্গভূমির সঙ্গে জন্মভূমিরও একটা মিল আছে।

সম্প্রীতি মুখার্জি:
আমার পছন্দ পশ্চিমবঙ্গ৷ কারণ ছোট থেকে পশ্চিমবঙ্গ শুনে বড় হয়েছি৷ নামটার মধ্যে একটা আলাদা ব্যাপার রয়েছে৷ আর বাংলা পছন্দ নয় বলে, বঙ্গকেও পছন্দ নয়৷

শুভায়ন বসাক:
বাংলা নামের বিরোধী আমি৷ কারণ যে ইস্যু নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে, যদি ঠিকঠাক কনটেন্ট থাকে তবে সকলে শুনতে বাধ্য৷ আর নাম পরিবর্তন করে রাজ্যের উন্নতি হয়না৷ বাংলা বললে অনেকে বাংলাদেশও ভাবতে পারে৷

সৌরভি কুণ্ডু:
ফঙ্গ বা বাংলা কোনটাই নয়, পশ্চিমবঙ্গই বেশি পছন্দের৷ কারণ নামটার সঙ্গে অনেক নস্টালজিয়া জড়িয়ে৷ এছাড়া এই নামের সঙ্গেই বহু বিপ্লব, মহান ব্যক্তির নাম জড়িয়ে রয়েছে৷

সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন :
পশ্চিমবঙ্গ নামটি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তাকে কিভাবে মুছে ফেলা যায়? ১৯৪৭ থেকে পশ্চিমবঙ্গ নামটিও ‘আমরা’ হয়ে উঠেছি, অতীতনিষ্ঠভাবে। পশ্চিমবঙ্গ নামটির ভিত্তি অন্তত বাস্তব ইতিহাসে, অন্তত স্রেফ ‘বঙ্গ’র তুলনায়। যে ঐতিহাসিক এলাকা থেকে বঙ্গ নামটির উদ্ভব, সেটি বর্তমানে পুরোপুরিই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে, মূলত বাংলাদেশের ফরিদপুর-মাগুরা-শরীয়তপুর-ঢাকা এলাকায়।

পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলা” রাখার পক্ষেও রয়েছেন কেউ কেউ :
সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় :
পশ্চিমবঙ্গ নামের কোনো অর্থ নেই। শুরুতে এই রাজ্যটি বঙ্গভূমি নামে পরিচিত ছিল। পার্টিশনের (১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের) পর রাজ্যটির নাম পরিবর্তন করা হয়। আমাদের অনেকেরই ওই নাম পছন্দ ছিল না। তাই সর্বশেষ এই উদ্যোগকে আমি নতুন করে নামকরণ বলব না, বরং এটি প্রকৃত নামে ফিরে যাওয়া।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়:
আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। স্বাগত জনাই এই সিদ্ধান্তকে, এই নামকে। অনেকদিন আগেই হওয়া উচিৎ ছিল। পশ্চিমবঙ্গ নামটা কেন এতদিন আমাদের ঘড়ের ওপর চেপে আছে আমি তো বুঝি না। নাম পরিবর্তন কারার এই প্রস্তাবটা শুভ প্রস্তাব।

সুবোধ সরকার:
এটার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল বেঙ্গল বা বঙ্গ বা বাংলা হলে অ্যালফাবিটিকালি আমরা অনেক ওপরে থকবো। এতে একটা টেকনিক্যাল সুবিধা হবে। সে দিক থেকে নাম পাল্টানো যুক্তিযুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ নামের পেছনে একটা ঐতিহাসিক কারণ ছিল। কিন্তু, এখন যেহেতু ইস্টবেঙ্গল নেই, সুতরাং ওয়েস্ট বেঙ্গলেরও কোনও অর্থ নেই। সেজন্যই আমার মনে হয়, বঙ্গ বা বাংলা হলে অনেক বেশি সুন্দর হবে।

বাবুল সুপ্রিয়:
বঙ্গ নামের প্রস্তাবকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। তবে রাজ্যের নাম বঙ্গ হোক এটা চান না তিনি। কারণ বঙ্গ নামে একটি বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। তার প্রস্তাব রাজ্যের নতুন নাম হোক বাংলা আর ইংরেজিতে হোক বেঙ্গল।

শুভম চক্রবর্তী:
আমি বাংলা নামটাই বেশি পছন্দ করি৷ কারণ বঙ্গর সঙ্গে বেশি রিলেট করতে পারছি না নিজেকে৷

জিত্ বসু:
বাংলাকেই বেশি পছন্দ৷ কারণ এখন আর পূর্ববঙ্গ নেই তাই পশ্চিমবঙ্গ না থাকাই ভালো মনে হয়৷ তবে আমার একটা বিষয়ে আপত্তি৷ যে ভাবা বিধানসভায় প্রস্তাবটি পাশ করানো হল সেখানে আপত্তি আমার৷ কারণ বিরোধী মতও শোনা উচিত৷

শ্রাবণী দাস:
বাংলাকেই বেশি পছন্দ করি৷ কারণ বাংলা অনেক বেশি রিপ্রেজেন্ট করে৷ আর এর সঙ্গে বেশি নিবিড় সম্পর্ক৷ তবে তিনটি বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজিতে আলাদা না করে একই করলে ভালো হত৷

আমি বাঙালি, সেটাই প্রথম মনে হয় : তন্ময় বোস, সঙ্গীতশিল্পী
‘আমার পরিচয়টা মনে পড়িয়ে দেয় ‘বাংলা’ শব্দটা। যখন পূর্ব বাংলা ছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন সেই প্রয়োজনটা আর নেই। তাই আমার মনে হয় এটা এক দিক থেকে ভালোই। এতে অনেক সুবিধে হবে বলেই শুনছি। তবে এটা একেবারেই আমার ব্যক্তিগত ধারণা। পুরোটা না দেখে মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে আমি নিজে কিন্তু পূর্ববঙ্গের মানুষ। তাই নামটা ভালোই লাগছে।’

মিষ্টির কথাই মনে পড়ে : জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শেফ
‘নাম পরিবর্তনের থেকেও অনেক বড় বড় ইস্যু আছে। সেগুলোকে আগে ঠিক করা উচিত বলে আমার মনে হয়। নাম পরিবর্তন হলে আমার কাজের কী সুবিধে হবে? এখনও যা করি পরেও তাই করব। তাই এই আলোচনায় গিয়ে কোনও লাভ নেই। তবে ‘বাংলা’ বললেই প্রথমে এখানকার মিষ্টির কথাই মনে হয়।’

বাংলা ভাষার কথা মনে হয় : অনিবার্ণ ভট্টাচার্য, অভিনেতা
”বাংলা’ বলতেই প্রথমে বাংলা ভাষার কথা মনে হয়। বাংলাদেশের কথাও মনে পড়ে। হিন্দি ভাষীদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ‘বাংগাল’ নামেই পরিচিত। রাজনীতির অলিন্দেও ‘বাংগাল’ শব্দটা প্রচলিত। ফোনেটিকালি কেমন লাগছে সেটা বড় ব্যাপার নয়। আশা করব এই নাম পরিবর্তনের ফলে আমাদের রাজ্যের কিছু সুবিধে হবে। আলোচনাতেও তেমনই সম্ভাবনা উঠে এসেছে। তবে বাকিটা অবশ্যই নেতারা বলতে পারবেন।’

বাংলা মানেই আমার শহর: পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার, ফ্যাশন ডিজাইনার

‘আমার কিন্তু মনে হয় নামটা আরও বেশি রিজিওনাল হয়ে গেল। একটু কনটেমপোরারি, গ্লোবাল নাম হলে আমাদের একটু সুবিধে হত। এমনিতেই আমরা এখানকার ডিজাইনাররা একটু সাইডলাইনড হয়েই থাকি ন্যাশনাল মার্কেটে। সেখানে নামটাও আঞ্চলিক হয়ে গেলে খুব মুশকিল। তবে ‘বাংলা’ শব্দটা শুনলেই মনে হয় আমার শহর। আমার হ্যাশট্যাগও রয়েছে ‘মাই সিটি’ বলে।’

ভাষার কথাটাই প্রথম মাথায় আসে : দর্শনা বণিক, মডেল, অভিনেত্রী
‘বাংলা মানেই আমার ভাষা। কিন্তু এর সঙ্গে দুর্গাপুজো, মিষ্টি, এখানকার খাবারও রয়েছে। আমার মনে হয় ভালোই হবে নাম বদলালে। কারণ এখনও যখন ন্যাশনাল লেভেলে কাজ করতে যাই, ‘বেঙ্গল’ থেকে এসেছি বলি। তাঁরাও সেভাবেই বোঝেন। তাই আমার মনে হয় না এতে আমাদের কোনও সমস্যা হবে।’

বাংলা মানে আমার পুরো পরিচয়: ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা
“‘বাংলা’ শুধু একটি শব্দ নয়। এটা একটি পুরো এনটিটি। আমার পুরো পরিচয়। অনেক বড় একটা ব্যাপার। আর কিছুদিন আগেই সেটা আমি খুব ভালো করে উপলব্ধি করি। আমেরিকা গিয়েছিলাম। ওখানে যেখানেই যাচ্ছি, দেখছি কত বাঙালি রয়েছেন। সবাই বাংলায় কথা বলছেন। তাই আমার মনে হয় বাংলা শুধু একটা রাজ্য বা দেশ নয়। তার থেকে অনেক বড় ব্যাপার। যা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

ইংরেজ কিংবদন্তী উইলিয়াম শেক্সপিয়র বলতেন নামে কিই বা এসে যায়; গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক তার সুবাস একই থাকে। আবার প্রাচ্যে রবীন্দ্রনাথ নামকরণকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করতেন। কিন্তু তাঁর জমানা গেছে। এখন ব্র্যান্ড ভ্যালুর যুগ।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ রাখার সিদ্ধান্ত হবে বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। তার পাশে ‘বাংলা’ নাম নিয়ে ভারতের একটি রাজ্য বা প্রদেশ থাকবে, তা কী শোভনীয় এবং বন্ধুসুলভ হবে?

বাংলাদেশ ও বাংলা দুটি ভিন্ন শব্দ হলেও ‘বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলা’ নামের মধ্যে রয়েছে গভীর সম্পর্ক এবং নিবিড় সমার্থকতা। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ ‘বাংলা’ নামে পরিচিত ছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ ছিল প্রেরণাদায়ক স্লোগান। এর অর্থ বাংলা নামক স্বাধীন ভূখণ্ড অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ এবং ‘জয় বাংলা’ সমার্থক। সংগত কারণে ‘বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ’ সমার্থক শুধু তাই নয়, ‘জয় বাংলা’ কথাটি আমাদের জাতীয় স্লোগান হিসেবে অতি উঁচু মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ রাখা হলে বাংলাদেশের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এবং আমাদের স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত কথাটি একই সঙ্গে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করবে।

অধিকন্তু বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়েও বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি হবে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ এটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। এখানেও ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলা’ নামে প্রতিষ্ঠিত। তাই ‘বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলা’ দুটো সমার্থক। এখন যদি জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয় তাহলে এমন সংশয় সৃষ্টি হতে পারে, যে শুধু বাংলাদেশকে নয়, ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের কথাও বলা হচ্ছে।

কেবল সংসদে রাজ্যের নেতাদের আগে বক্তব্য রাখার জন্য এমন একটি সিদ্ধান্ত কোনোভাবে যৌক্তিক হতে পারে না, যা বাংলাদেশ নামের সঙ্গে বিব্রত পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। অবশ্য বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্লোগান, জাতীয় সংগীত, বাংলা ভাষা প্রভৃতি নিয়ে দ্ব্যর্থকতা এবং সংশয় সৃষ্টি না করলে বিষয়টি নিয়ে এত ভাবা হতো না।

মমতার যুক্তি:
তবে মমতা এসব যুক্তি অগ্রাহ্য করে বলেছেন, দ্ব্যর্থক হওয়ার কোনো হেতু নেই। কারণ একটি শব্দের একাধিক অর্থ থাকে এবং একই শব্দ প্রায়োগিকতা বিবেচনায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। তিনি আরো বলেছেন, পাকিস্তানে যেমন পাঞ্জাব আছে, ভারতেও পাঞ্জাব আছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার, দুই দেশেই পাঞ্জাব একটি প্রদেশের নাম, কোনো রাষ্ট্রের নাম নয়।

পশ্চিমবঙ্গের জনৈক লেখকের অভিমত:
,‘বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলা’ দুটি ভিন্ন নাম। একটি পাঁচ বর্ণের এবং অন্যটি তিন বর্ণের। একই নাম নয়, অতএব আপত্তির কোনো সুযোগ নেই। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের জন্যও আপত্তিকর। কেউ ভেবে নিতে পারে, বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গও যেন স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এটাই ঘোষণা করছে। বাংলা নাম রাখার সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন কেবল কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কি কোনো আপত্তি জানানো হয়েছে?

ভারতের জনৈক প্রশাসকের অভিমত:
ভারত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। তার রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা এবং সার্বভৌম ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। এতে অন্য কারো আপত্তি-অনাপত্তি বিধেয় নয়। ব্যক্তি স্বাধীনতার মতো রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

বিশ্ব বাংলা :
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বিশ্ব-বাংলা নামে পশ্চিমবঙ্গের নতুন নামের ব্র্যান্ড ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে। এবার কেন্দ্র নামের অনুমোদন দিলে সেই ব্র্যান্ডিং আরও জোরদার করা হবে বলেও সরকারি সূত্রগুলো আজ নিশ্চিত করেছে।

শেষ কথা:

ভারতের একটি রাজ্যের কি নাম হবে বা হবে না এটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। এ নিয়ে কোন কথা বলার প্রয়োজনীয়তা নেই বা থাকতে পারে না। এটি নীতির কথা। আলোচ্য ক্ষেত্রে নাম পরিবর্তনের যে বিষয়টি এসেছে তাকে নিছক নাম পরিবর্তনের ফ্রেমে দেখা বোধহয় সংগত নয়। ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ রাখা হলে সংসদে পশ্চিমবঙ্গের নেতারা আগে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাবেন। কারণ ইংরেজি বর্ণমালায় B বর্ণটি W বর্ণের আগে। এটি খুব হালকা, হাস্যকর এবং ঠুনকো যুক্তি। এমন একটি বালখিল্য যুক্তির ভিত্তিতে এমনভাবে একটি রাজ্যের নাম পরিবর্তন করা সমীচীন নয়, যা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামের বৈশ্বিক মর্যাদায় সামান্যও সংশয় সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাতো অবিভক্তই ছিল। বাংলা নিয়ে পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, সুবে বাংলা। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা। অর্থাৎ ভারতবর্ষ যখন মুগলদের শাসনে ছিল তখন ঢাকা ছিল বাংলার রাজধানী। পরে মুর্শিদাবাদ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী থাকাকালেই এ দেশিয় বিশ্বাসঘাতকদের কারণে বাংলার স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়েছিল। সেটাই ছিল স্বাধীন বাংলার মস্ত ট্রাজেডি। বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যদিয়ে যে ইংরেজ শাসন প্রথমে বাংলায় ও পরে সারা ভারতে স্থান করে নেয় তার স্রষ্টা কোলকাতাকেন্দ্রিক কায়েমী স্বার্থবাদীরা।

বৃটিশরা তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে যে প্রদেশ গঠন করেছিল তার রাজধানী করা হয়েছিল ঢাকাকে। এই নতুন প্রদেশের কারণে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের কিছুটা সুবিধা হয়েছিল বিধায় সেটি মেনে নিতে পারেনি কোলকাতাকেন্দ্রিক দাদারা। বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে বলে তারা বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তখন ভারতের উঠতি সুবিধাভোগী হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি, শিল্পপতি, উকিল, জমিদার, সাংবাদিক, রাজনীতিকসহ প্রায় সবাই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা শুরু করে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভারতে বিশেষ করে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিক বিভাজন পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বঙ্গভঙ্গ রোধে সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয় একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী।

এই সন্ত্রাসীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল। মূলত বঙ্গভঙ্গের মধ্যদিয়ে যেটুকু সুবিধা এ অঞ্চলের মুসলমানদের পাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়ে সেটি বন্ধ করতেই ঢাকা কেন্দ্রিক প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রুখে দেয়া হয়।

১৯০৫ সালে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ ঠেকাতে দেবতার সামনে যেসব হিন্দু নেতা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাদের উত্তরাধিকাররাই ভারত বিভাগের আঁচ করতে পেরে বঙ্গভঙ্গের দাবি করেন । ভারতীয় হিন্দু মহাসভা নেতা ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ সালে এক বিবৃতিতে বঙ্গভঙ্গ দাবি করেন এবং তদানুযায়ি এ সালের ৫ এপ্রিল তারেকশ্বরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোকে নিয়ে হিন্দুবঙ্গ প্রদেশ গঠনের দাবি উত্থাপন করেন। এই দাবির ভিত্তিতেই নিখিল ভারত কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালিনী ‘৪৭ সালের মার্চ মাসে বঙ্গভঙ্গ দাবির সমর্থনে প্রকাশ্য বিবৃতি দান করেন। এই আলোচনা এ জন্য যে, আজকে যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে সেটি মূলত কোলকাতাকেন্দ্রিকতারই ফসল।

আরবীয় বনিকদের এ অঞ্চলে ব্যবসা করতে আসার মধ্যদিয়ে যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল সেটিই মূলত এ অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং আলাদা মাত্রা দিয়েছিলে। এই বিভাজনেরই সুনির্দিষ্ট ফলাফল মূলত পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তি এবং পরে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

১৯৫১ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায়— খোদ কলকাতাতেই জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ পূর্ববঙ্গ থেকে দেশভাগের পরে কলকাতায় আসা জনগোষ্ঠী। সেই অনুপাত পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে আজ অবধি শুধুই বেড়েছে। তারা কেন এখানে, তার কারণ ১৯৪৭। ‘পশ্চিম’বঙ্গ সেই ঘটনার ফল। রাজনৈতিকভাবে ইংরেজ শাসনাধীন উপমহাদেশের আইনসভায় সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধি পাঠাতো যুক্ত বাংলা। দেশভাগের পর দিল্লির রাজনীতিতে বাংলা ও বাঙালির প্রান্তিকতার কারণও বাংলাদেশ ভাগ।

রাজনৈতিক বৈরিতা সত্ত্বেও রাজ্যের নাম পরিবর্তনে বিজেপি এবং তৃণমূলের একমত হওয়ার বিষয়টি লক্ষণীয়। শুরু থেকেই ওয়েস্ট বা প দিয়েই তো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কাজ চালিয়ে আসছেন। আজ হঠাৎ করে কেন মনে হলো বা হতে শুরু হলো এর ফলে তিনি অচ্ছুত হয়ে গেছেন। তাকে সময় কম দেয়া হচ্ছে। দিল্লী যদি তাকে বঞ্চিত করতে না চায় তাহলে তার জন্য আরো দুমিনিট সময় নির্ধারণ করা কোন ব্যাপার বলে মনে হবার নয়। আজ সময় পাননি তো আগামীকাল পাবেন। এটা নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের জন্য কোন কার্যকর যুক্তি হতে পারে না।

বাংলা আমাদের। রক্ত দিয়ে আমরা বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা করেছি। মহান শহীদ দিবসকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলা নামের দেশ প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা। বিশ্বের দরবারে যে বাংলার পরিচিতি রয়েছে তার নির্মাতা প্রতিষ্ঠাতা, রূপায়নকারী আমরা এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণ। মহান আত্মত্যাগের পথ ধরে বাংলা আজ বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত। সেই বাংলা নিয়ে টানাটানি কেন?

আমাদের অতি পরিচিত কিছু দেশাত্মবোধক গানের দ্যোতনার অন্তর্নিহিত চেতনা অদূর ভবিষ্যতে সাংঘর্ষিক হতে পারে দুই বাংলার নামের জেরে। জাতীয় সঙ্গীত নিয়েও একই ভাবনা প্রযোজ্য। ধরুন, কলকাতার ইডেন গার্ডেনে কোনো এক আন্তর্জাতিক ইভেন্টে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। স্টেডিয়ামে উপস্থিত ওই বাংলার দর্শকরা পরাবাস্তব জাতীয় একাত্মতা কি বোধ করবেন না? ভাষাগত সমিলতার কারণে সোনার বাংলার স্বপ্ন তো তারাও দেখে। কিংবা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘ও আমার বাংলা মা গো’, ‘বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা’ ইত্যাদি গানগুলোর কথা ও সুরের চেতনা নব্য ‘বাংলা’ প্রদেশের মননের সঙ্গে দ্রবীভূত হবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?

ভারত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্বস্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র। মোদি সরকারের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক একটা ঐতিহাসিক, ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে। তার ওপর, মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে ভারত আমাদের চির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে রেখেছে। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ আর সহমর্মিতার অধিকারেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে আমার প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার জন্য বিনীত অনুরোধসহ বলছি- ‘প্রিয় শ্রদ্ধেয় মমতাদি, পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ রাখার বদলে যেসব নাম রাখা যেতে পারে : (সব ভাষায়ই ব্যবহার হবে যে কোনো একটি নাম) ‘বঙ্গ’, ‘বঙ্গরাজ্য’, ‘বঙ্গপুর’, ‘বঙ্গস্থান’, ‘বঙ্গমাটি’ অথবা ‘বঙ্গভূমি (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রদত্ত)। আশা করি, এতে সব কূলই রক্ষা হবে।

একটু ভাবুন:
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই ভারতনির্ভর হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোন না কোনভাবে ভারতীয় প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তো অনেকটাই প্রত্যক্ষ করার মত। এই বাস্তবতায় পশ্চিমবঙ্গের নাম পরির্তন করে বাংলা রাখার বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই বরং একে ভারতীয়দের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসেবে দেখার যথেষ্ট কারন রয়েছে। যারা মনে করছেন, দেখি কী হয়, তাদের বোধহয় একটু ভাল করে চোখ পরিষ্কার করে দেখার চেষ্টা করা ভাল।

যদিও আমাদের আম জনতা এখনো এই ইস্যুটার গুরুত্ব ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছেন না, অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ তাদের ‘টিএসসি’র চুম্বন দৃশ্যের মতো তা ধরিয়েও দিচ্ছেন না। অথবা এমন হতে পারে এই ব্যাপারে তর্ক-বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার আগে যে যার অবস্থান থেকে এখনো জ্ঞান অর্জনে করে চলেছেন।

বাংলা নামের দেশ তো শুধু আমাদেরই আছে। দেশের সার্বভৌমত্ব এই নামের সঙ্গে সম্পূরক। ওপার বাংলার কারও ভুলে বাংলাদেশের নামে কোনো বাজে ইঙ্গিত করলে আমাদের দেশপ্রেমের ইজ্জতে আঘাত লাগে। এখন বহির্বিশ্বে ‘বাংলা’ নামের প্রদেশের সঙ্গে সুনাম-দুর্নাম ভাগাভাগি করতে হবে। এখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলের বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মতো পৃথক পৃথক অঞ্চলভিত্তিক জাতিতাত্ত্বিক অধিকার স্বনামে প্রতিষ্ঠিত করার এই কূটকৌশল আমাদের ধীমান বুদ্ধিজীবী রাষ্ট্রপক্ষ কি বোঝেও বুঝল না? ভীষণ সূক্ষ কারসাজির এই বাংলা নামকরণ হয়ে গেলে আর ফেরার উপায় নেই।

দুই দেশের মানুষ অভিন্ন বাংলা ভাষায় কথা বললেও নব্য প্রস্তাবিত বাংলা আর স্বাধীন বাংলাদেশ দুটো আলাদা অস্তিত্ব ধারণ করে আসছে। নামের সাদৃশ্যে দ্বন্দ্ব এখন বাড়বে বৈ কমবে না। এর পেছনে গভীর সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ইতিহাসে এমন উদহারণ আছে। যেমন একই ভাষায় কথা বললেও ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড ভিন্ন জাতিসত্তা ধারণ করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ লড়াই চালিয়ে গেছে। এই স্বকীয়তা বোধের দায়বদ্ধতা আমাদের আগে প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল না। এখন মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেরী না করে আমাদের সরকার ও বিজ্ঞ সুশীল সমাজের উচিত এই বিষয়ে সরাসরি দিল্লির সঙ্গে কথা বলা। না হলে ইতিহাসে প্রমাণিত হবে বলিহারি বুদ্ধি মমতা দিদি মনির!

ভবিতব্য:
পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র নয়; ভারত ইউনিয়নভুক্ত একটি প্রদেশ। একদিন না একদিন পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন হবেই। তখন কোনটি হবে তাদের জাতীয় সঙ্গীত? নিশ্চয় আমার সোনার বাংলা নয়? তাদের মেধাবী গীতিকাররা জাতীয় সঙ্গীত রচনা করে নেবে (অবশ্য পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে প্রদেশগুলোর জন্য স্বায়ত্তশাসন থাকে, পৃথক পতাকা, পৃথক জাতীয় সঙ্গীতও থাকতে পারে। তা ছাড়া গণভোটের মাধ্যমে তাদের স্বাধীন হওয়ার অধিকারও থাকতে পারে।

গণতন্ত্রের এটাই মূল কথা। ভারতকে একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয়। সেখানে কি উল্লিখিত ব্যবস্থাদি রয়েছে? না থাকলে ভারতের সেটা কেমন গণতন্ত্র!)।

যা হোক, পশ্চিমবঙ্গের নাম আর যা-ই রাখা হোক, বাংলা হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে গুবলেট পাকিয়ে যাবে।

সঞ্জয় কুমার দত্ত : ফ্রিল্যান্সার, লেখক, ব্যাংক কর্মকর্তা

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology