আজ, সোমবার | ১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | রাত ২:০০


১৪ ডিসেম্বর : জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা

মাগুরা প্রতিদিন : ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাবিধুর দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় যখন নিশ্চিত, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।

বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, কবি ও সাহিত্যিকদের রাতের আঁধারে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝে গিয়েছিল—পরাজয় অনিবার্য। তারা জানত, এই বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। তাই স্বাধীনতার প্রাক্কালে জাতিকে মেধাশূন্য ও পঙ্গু করে দিতেই এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।

ইতিহাসের অন্যতম বর্বর অধ্যায়
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের এই হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম জঘন্য ও বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করে। হত্যার পর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়।

১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনরা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের গলিত ও ক্ষতবিক্ষত লাশ খুঁজে পান। অধিকাংশ লাশের চোখ, হাত ও পা বাঁধা ছিল। অনেকের শরীরে ছিল গুলির চিহ্ন ও ধারালো অস্ত্রের আঘাত। ভয়াবহ ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের লাশ শনাক্ত করতে পারেননি।

শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা
১৯৭২ সালে প্রকাশিত জাতীয় বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদন এবং আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজ উইক-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখায় শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন বলে উল্লেখ করা হয়।

তথ্য অনুযায়ী নিহতদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ছিলেন সর্বাধিক। এছাড়া চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরাও এই হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।

তদন্ত ও ভয়াবহ তথ্য
স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়—পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী প্রায় ২০ হাজার বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়ে হত্যার ছক আঁকা হয়। যদিও পরিস্থিতির কারণে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, যিনি ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হন।

মূল পরিকল্পনাকারী ও দোসররা
বুদ্ধিজীবী নিধনের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। অপারেশন সার্চলাইটের অংশ হিসেবেই এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়। যুদ্ধের শেষ দিকে আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়।

স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে রাও ফরমান আলীর হাতে লেখা একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যাতে বহু বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়। এই ডায়েরিই হত্যাকাণ্ডে তার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার অন্যতম প্রমাণ।

তদন্ত কমিশনের দলিল অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের মধ্যে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রাজা, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্নেল তাজ, কর্নেল তাহের, ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, ড. মোহর আলী, এবিএম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীন।

আল-বদর বাহিনীর প্রধান ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান।

হত্যার বাস্তব চিত্র
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই ঢাকায় কারফিউ জারি করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়িত হয়। ওই দিন প্রায় ২০০ জন বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখ বেঁধে নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে গিয়ে তাদের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। পরে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে তাদের হত্যা করে ফেলে রাখা হয়।

জাতির বিবেকের প্রতি শ্রদ্ধা
শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন জাতির বিবেক ও ভবিষ্যৎ নির্মাতা। তাদের হত্যা ছিল সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রোধের অপচেষ্টা। কিন্তু সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজও তাদের রক্তের ঋণ বহন করে চলেছে।

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের শোকের দিন, শ্রদ্ধার দিন এবং অঙ্গীকারের দিন—
– যেন ইতিহাস বিকৃত না হয়,
– যেন ঘাতকদের আদর্শ আর কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে,
– আর যেন জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগ কখনো বিস্মৃত না হয়।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology