ফয়সাল পারভেজ : বৃহত্তর যশোর তথা মাগুরা, যশোর, ঝিনাইদহ এবং নড়াইল জেলার খ্যাতি এ অঞ্চলের খেজুর রসের সংস্কৃতি। শীতের চাঁদর জড়িয়ে কাঁচা খেজুরের রস, রস জ্বালিয়ে তৈরি গুড়, বাহারি আকারের পাটালি, রসের পিঠা, ঢেকিছাটা চালে ক্ষিরের স্বাদ গ্রহণ সবই এ অঞ্চলের মানুষের চিরায়ত ঐহিত্যের অন্যতম অংশ।
এক সময় শীতের সারা মৌসুম জুড়েই মাগুরার ছোটবড় বিভিন্ন বাজারে চলতো খেজুর রসের কারবারি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এ অঞ্চলে এখন চিরেচেনা সেই সংস্কৃতিতে পড়ন্ত বিকেলের আবহ। স্থানীয় বাজারগুলোতে এখন আর দেখা মেলে না গাছিদের রসের সারি সারি হাড়ি নিয়ে বসার অতি পরিচিত সেইসব ছবি।
বৃহত্তর যশোরের খাজুরা খেজুর গাছের কারণেই বিখ্যাত। আর খাজুরার পার্শ্ববর্তি মাগুরা জেলার শালিখা অঞ্চলে অন্য উপজেলার তুলনায় খেজুর গাছের আধিক্য দেখা যায়। কিন্তু শীতকালে মাগুরা-যশোর সড়ক সংলগ্ন বাজারগুলোতে ভোর সকালে গাছিদের রসের হাড়ি নিয়ে বসে যাওয়ার যে পরিচিত দৃশ্য সেটি এখন একেবারেই নেই। কালে কালে এই অঞ্চলগুলো থেকে যেন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে খেজুর রস কেন্দ্রিক গ্রামবাংলার সেই লোকাচার ও সংস্কৃতি।
স্থানীয় গাছিরা বলছেন, খেজুরের গাছ এক সময় গ্রামে প্রচুর পরিমাণে থাকলেও কালক্রমে সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে নানা রকম চাহিদার জন্য। খেজুর গাছের ভাল চাহিদা রয়েছে ইট ভাটা গুলোতে, জ¦ালানী কাঠ ও কয়লার তুলনায় খেজুর গাছ সস্তা হবার কারণে ইট-ভাটায় প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে। কেননা, খেজুর গাছ ব্যবহার হলে ইটের রঙ বেশ গাঢ় হয় বলে জানা যায়। যে কারণে দিনে দিনে মাগুরার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভাটার চাহিদা মেটাতে গিয়ে অধিকাংশ খেজুর গাছই কাটা পড়ে গেছে। এ অবস্থায় শীত মৌসুমে এই পেশার সাথে জড়িত গাছিরা পেশা বদলে অন্য পেশাতে চলে গিয়েছে। দেখা মেলে না তাই মাগুরার পথে প্রান্তরে কাঁধে বাঁক ঝুুুলিয়ে গাছিদের বিচরণ।
খেজুর রস আহরণ করার জন্য গাছ কাটার প্রক্রিয়াকে বলা হয় আঞ্চলিক ভাষায়“গাছ ঝুড়া” বা “গাছ ছিলানো”। গাছের পুরণো ডাল কেটে ফেলা দেওয়ার পর সেই ডালে তৈরি খেলনা গাড়ি আর ঢালের প্রান্ত ঘিরে থাকা নরম শরফা পুড়িয়ে কচুর পাতার হাওই বাজির সঙ্গে শিশুদের যে পরিচিত দৃশ্য সবই এখন অনুপস্থিত।
মাগুরা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রমতে, এক যুগ আগেও মাগুরার বিভিন্ন এলাকায় যেসব খেজুর গাছ ছিল তার প্রায় নব্বই শতাংশই নিধন হয়ে গেছে। যে কারণে শীতের শুরুতে গাছিদের খেজুর গাছ ঝোড়া বা কাটার সেই পরিচিত দৃশ্যের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের অনেকের নেই কোন পরিচিতি।
মাগুরার মহম্মদপুর অঞ্চলের খেজুর গাছি বিল্লাল বলেন, আমাগের দুইশডার উপরে গাছ ছিল। টাকার জন্যি ভাটার মালিকগের কাছে বিক্রি করে দিছি। এহন ত্রিশটে আছে, তাও সেগুলো কাটা হয়না।
সদর উপজেলার আবালপুর গ্রামের গনি বিশ্বাস বলেন, রস খাওয়ার জন্য কিছু গাছ রেখে দিয়েছি। ছেলে মেয়েরা ঢাাকায় থাকে। তাদের সন্তানেরা শীতে খেজুরের রস খেতে চায় বলে।
স্কুল শিক্ষক পলাশ বলেন, এখনকার শিশুরা জানেই না খেজুরের রস কি জিনিস। আমাদের সময় ভোর সকালে বাজারে গিয়ে এক গ্লাস রস না খেলে শীতকালই বৃথা মনে হতো। এখন সেই সব আমেজ নেই।
খেজুরের রস পাওয়া না গেলেও মাগুরা শহরের বিভিন্ন বাজারে এখনো খেজুরের গুড় ও পাটালি দেখতে পাওয়া যায়। তবে এগুলো কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও যশোর থেকে আসা বলে জানা যায়।
মাগুরা শহরের গুড় বিক্রেতা হাফিজ বলেন, আমাদের অঞ্চলে যে রস পাওয়া যায় তাতে আর গুড় হয় না। খাবার রসের চাহিদাই মেটে না।
তবে কৃষি বিভাগের অভিমত, বিগত সময়ে নানা কারণে খেজুর গাছ নিধন করা হয়েছে। কিন্তু খেজুর গাছ কখনো রোপন করার প্রতি নজর দেয়া হয়নি। আবাহমান বাংলার ঐতিহ্য সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান এই খেজুরের গাছ টিকিয়ে রাখতে নতুন করে রোপনের প্রতি সরকারি বেসকারিভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন।