সুলতানা কাকলি : প্রায় এক বছর হতে চলল। পৃথিবীর তাবত মানুষকূল করোনার ভয়ংকর থাবায় আতঙ্কিত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। করোনা প্রতিরোধের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য উদাত্ত আহবান করা হচ্ছে বারবার। কেউ যেনো এই রোগের থাবায় আক্রান্ত হয়ে অকালে বিদায় না নেয় এ জন্যই নানা সতর্কতা।
কিন্ত জীবন থেমে নেই।
জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষকে রাস্তায় নামতে হচ্ছে।
আমাকেও কখনও-সখনও প্রয়োজনে বাইরে বেরুতে হয়। তখন যতদূর পারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ মোতাবেক নিজকে সুরক্ষা করে রাস্তায় নামি। কিন্তু অসংখ্য মানুষের মাস্ক বিহিন রাস্তায় চলাচল করতে দেখে আতঙ্কিত হই। সচেতন ব্যক্তিরা হয়তো সকল সাবধানতা রক্ষা করে পথে নামেন,তবুও কখন কোন চিপা-চাপা দিয়ে যে করোনা ঢুকে জীবনকে হুমকিতে ফেলে দেয় সে শংকা থেকেই যায়।
কারণবশতঃ আমাদের দুজনেরই যশোর যাওয়া প্রয়োজন তাই যথা সম্ভব প্রোটেকশন নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লাম। ভায়না মোড় মাগুরা থেকে দুজনে চেপে বসলাম লক্কর ঝক্কর এক লোকাল বাসে। করোনা ভয়ে আতঙ্কিত মনকে সবলে ঝাড়া দিয়ে শরীর থেকে ছিটকে ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত করলাম। মাত্র কয়েক ঘণ্টার যাত্রা পথে মনের গভীরতা দিয়ে দেখলে কত কিছুইনা চোখে পড়ে। ছুটলো গাড়ি। চলছে তো চলছে। ভিটাসাইর মোড়ে হঠাত্ চোখে পড়লো সাত সকালে তাফাল ভরে শিং, শোল, টাকি, কৈ মাছ নিয়ে জেলেদের সরগরম।
একেএকে ভীড় জমছে মাছ কে ঘিরে।
আহ্! শীতের সকালে বিল বাওড়ের টাটকা মাছ। ধনে পাতা দিয়ে বিভিন্ন কায়দায় ভর্তা, চচ্চড়ি খেতে লাগে খাঁসা। বাড়ছে গতি ছুটছে গাড়ি। দু’পাশের মাঠগুলো যেন আমাদের সাথেই দৌড়াচ্ছে। মাঠের ধান কাটা শেষ। কোনো মাঠে ধান মাড়াই এর কাজ চলছে। আবার কোথাও মাঠের পর মাঠ নিস্তব্ধ নিরবতায় ঠন ঠন করছে। কোনো মাঠে চাষীদের শীতের সব্জি রোপনের ব্যস্ততা শুরু। গ্রামবাংলায় চলছে নবান্নের উত্সব।
কোথাও দূর মাঠে দু চারটা খেজুর গাছ চোখে পড়লো, গাছের মাথায় ক্যাঁড়ে ঝুলছে। খেজুরের রস! ইসরে! কতোকাল খেজুরের রস খাই না! সেই ছোটোবেলা অনেক ভাইবোনের মাঝে মগ ভরে খেজুরের রস মুড়ি দিয়ে খাওয়া। আহারে! সেই স্মৃতি!
আড়পাড়া ব্রীজের আগে এক গৃহস্তের বাড়ির সামনে দেখি কিছু গরু । দাঁড়িয়ে বসে জাবর কাটছে।
হয়তো সকালের খাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে জোয়াল ঘাড়ে চাপিয়ে বের হবে গৃহস্তের কোনো জমিতে চাষ দিতে! শতখালি বাজারে এসে যাত্রী নেবার জন্য গাড়ি থামলো। পাশেই দেখি ছোট্ট একটা ছেলে একটা লাঠির মাথায় কিছু হাওয়ায় মিঠা আর কিছু খেলনা নিয়ে পায়ের চপ্পল জোড়া মাটিতে রেখে জাবড়ে বসলো। করোনার ভয় উপেক্ষা করেই মাস্ক ছাড়াই দুটো পয়সার আসায় কোনো ক্রেতার অপেক্ষায় তাঁর চোখ প্রসারিত। এই বয়সে এদের পিঠে থাকবে বই এর ব্যাগ, হাতে থাকবে পানির পট। কিন্ত এ এক আলাদা জীবন, বেঁচে থাকার লড়াই। ছেলেটির সেই মায়াভরা মুখটি ভুলতে পারিনি।
গাড়ি ফের ছুটতে শুরু করলো। এবার চোখে পড়লো রাস্তার ধারে সামান্য কাঁদা পানিতে সিলভার এর হাড়ি ভাসিয়ে কিছু কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েরা গায়ে কাদা-মাটি মেখে মনের আনন্দে মাছ ধরছে। ভালই উপভোগ করলাম। আরোও চোখে পড়লো ইটের ভাটা, মাঠেই খড় শুকানো, খড়ের উপর কোনো গৃহস্ত বাড়ির পায়রার দল ঝাঁক বেধে বসছে খড়ের ফাকে ধান খুঁটে খাবার আশায়। এই দৃশ্যপট দেখতে দেখতে কখন গাড়ি যশোর পৌঁছালো বুঝতেই পারলাম না। কাজ শেষে দুপুরে ফেরার পথে আরোও কিছু মুগ্ধকর দৃশ্য মনকে প্রফুল্ল্ করে তুললো।
পথিমধ্যে কোন এক খোলা মাঠে গরু- ছাগলের হাট চোখে পড়লো। দলে দলে বিক্রেতা ও ক্রেতাদের আগমনে যায়গাটা রমরমা।মানুষের ভীড় ও ব্যস্ততা খুবই প্রাণবন্ত। ওদের দেখে মনে হয়নাযে, পৃথিবীতে করোনা নামক ব্যাধি মানুষের জীবনে কালশাপ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। কত নিশ্চিন্তে ওদের রাস্তায় চলাফেরা। গ্রাম বাংলার গো-হাটের দৃশ্য আর ওদের দেখে ওই মুহূর্তে আমিও একটু নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেললাম। আরোও দেখলাম দিপ্রহরে কৃষকেরা মাঠের শ্যালো মেশিনের পানিতে গোসল করে ভেজা গামছা ঘাড়ে নিয়ে বাড়ী ফিরছে।
মনে একটু আনন্দ হলো যে, বহুদিন ধরে সীমাখালী বাজারের ভেঙে যাওয়া সেতুটি নির্মাণের জন্য সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অনেকদিন পর রাস্তার দুপাশের নিরিবিলি ও গাছপালায় ঘেরা গ্রামগুলো দেখে হাতে আঁকা ছবির মত মনে হলো। গ্রামের সুর্নিমল বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়া মানুষেরা যান্ত্রিক শহরের মানুষের চেয়ে দীর্ঘায়ু ও সুস্থতার হার বেশী বলে আমার মনে হয়।
আমরা বাঙালি।
বাংলার আনাচে কানাচে এমন দৃশ্যপট সর্বদাই বিদ্যমান। আমরা সেভাবে দেখার চেষ্টা করি না। তাইতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাখের সেই অনুভূতি যেনো আবাড় নাড়া দিল-দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপরে, একটি শিশিরবিন্দু।
সুলতানা কাকলি: লেখিকা, সাবেক গার্লস গাইড