আজ, রবিবার | ৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | রাত ১০:২৮


দেশে ৬ মাসে খুন ১ হাজার ৯৩০ জন

মাগুরা প্রতিদিন : আয়ামীলীগ সরকারের পতনের এক বছর পার হয়ে গেলেও দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। উলটো সারাদেশে সহিংসতা, খুন, মব সন্ত্রাস, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, চাঁদাবাজি এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ক্রমেই বেড়েই চলেছে।

সরকার এবং পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। বড় ধরনের অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল। কিন্তু পুলিশের নিজস্ব পরিসংখ্যানেই উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। সূত্র: বিবিসি

তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি–জুন) দেশে খুন হয়েছেন ১ হাজার ৯৩০ জন। জুন মাসেই খুনের সংখ্যা ছিল ৩৪৩, যা বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অপরাধ বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। জানুয়ারিতে খুনের সংখ্যা ছিল ২৯৪। ফেব্রুয়ারিতে ৩০০, মার্চে ৩১৬, এপ্রিলে ৩৩৬, মে মাসে ৩৪১ জন খুন হন। শুধু খুন নয়, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, মব সন্ত্রাস, ছিনতাইসহ অন্যান্য গুরুতর অপরাধও বেড়েছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ৩৬৬টি এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১১ হাজারের বেশি।সরকারি অপরাধ পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত খুনের মোট সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৫৪ জন। এর পাশাপাশি ওই সময়ের মধ্যে ধর্ষণ হয়েছে ৪ হাজার ১০৫টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১২ হাজার ৭২৬টি, ডাকাতি ৬১০টি, দস্যুতা ১ হাজার ৫২৬টি, দাঙ্গা ৯৭টি এবং মব সন্ত্রাস ও গণপিটুনিতে প্রাণ গেছে ৮৩ জনের।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস উইং গত জুলাইতে দাবি করে, অপরাধের হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। তাদের ভাষায়, বড় ধরনের অপরাধের হার ‘স্থিতিশীল’, এমনকি কিছু কিছু অপরাধ কমেও এসেছে। তবে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের মধ্যে মনোবল ভেঙে পড়েছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় এবং পরবর্তীকালে পুলিশের উপর একাধিক হামলা হয়, অনেক পুলিশ কর্মকর্তা কর্মস্থল ত্যাগ করেন। কেউ কেউ জড়িয়েছিলেন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এবং গ্রেফতারও হন। এছাড়া থানায় হামলার ঘটনাও ঘটেছে বহু জায়গায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং চালু করে ‘ডেভিল হান্ট’ নামের বিশেষ অভিযান। যদিও এসব উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ অভিযানের মধ্যেই খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মব সন্ত্রাস ও ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়েছে।

এদিকে, ঢাকার গুলশানে এক সাবেক এমপির বাড়িতে সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় পুলিশের সক্রিয় পদক্ষেপ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এই ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতাসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, এই সংগঠনসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অনেকেই পরবর্তীতে চাঁদাবাজি, ক্ষমতা প্রদর্শন ও তদবিরে জড়িয়েছে।

অপরাধ বাড়লেও অনেক ঘটনাতেই পুলিশ হার্ড অ্যাকশন নেয়নি। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ দুর্বল ছিল, পুলিশ নিজেই আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে।
এর আগে, অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের অপরাধে পুলিশের ভূমিকা ছিল নিস্ক্রিয়, অভিযোগ উঠেছিল রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে অভিযুক্তরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু গুলশান ঘটনার পর এই প্রথমবারের মতো পুলিশ সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়।

ঢাকার ধানমন্ডিতে সমন্বয়ক পরিচয়ে লোকজন নিয়ে হামলা চালানোর পর তাদের থানা থেকে ছাড়িয়ে আনাও ছিল আলোচিত আরেকটি ঘটনা। এরপর মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রকাশ্যে একজনকে পিটিয়ে ও পাথর মেরে হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র সামনে আসে।

এই হত্যাকাণ্ডের মাত্র দু’দিন পর খুলনায় যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমানকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়। ঢাকার পাশের জেলা মাদারীপুরেও মসজিদে আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

সামাজিক মাধ্যমে এসব ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দিনদুপুরে ছিনতাই ও চাপাতি নিয়ে হামলার ঘটনাও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এভাবে প্রতিনিয়ত লাশ উদ্ধার হওয়া, অনেক লাশের পরিচয় না মেলা, কিংবা মব সন্ত্রাসে মানুষ হত্যার ঘটনা দেশে চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।

ছাত্রদের হত্যার বিচার যেমন দরকার, তেমনি পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনতে পুলিশ হত্যারও বিচার করতে হবে। না হলে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক হবে না।

এছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতাও বাড়ছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ বলছে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৩০টি, যার মধ্যে ৬৬টি ছিল দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ২২টি ছিল ধর্ষণের পর হত্যা। এ সময় গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৮৯ জন এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৪ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হওয়ায় তাদের পেশাদারিত্ব নষ্ট হয়েছে। একদিকে পুলিশ রাজনৈতিক চাপের মুখে ছিল, অন্যদিকে সরকারের পতনের পর তারা ভয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক মনে করেন, পুলিশের অনেক সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু ঘটনায় পুলিশ ব্যবস্থাও নিতে পারেনি, আবার কোনো কোনো ঘটনায় পুলিশ নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতায় ছিল। ফলে সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্নে আস্থা কমে গেছে।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology