আজ, শুক্রবার | ১৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | রাত ৪:৫৩


ধ্বংসের পথে কবি সৈয়দ ফররুখ আহমদের বসতভিটা

মাগুরা প্রতিদিন : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ কবি সৈয়দ ফররুখ আহমদ। সাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ের মাঝেও তিনি মানুষের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলেছেন। সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে বাংলার মুসলিম সমাজসহ দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্যে জাগরণের বাণী বহন করেছেন; সেই কবির স্মৃতিধন্য বসতভিটাটি আজ ধ্বংসের পথে।

মাগুরার মধুমতি নদীর পাড়ে মাঝাইল গ্রাম। এই গ্রামেই জন্মেছেন বাংলা সাহিত্যের দিকপাল রেনেসাঁর কবি খ্যাত সৈয়দ ফররুখ আহমদ।

মাগুরা শহর থেকে রাজধানী ঢাকার পথে কালো পিচ-পাথরে মোড়া মসৃন মহাসড়ক ধরে ১২ কিলোমিটার পথ পেরোলেই ওয়াপদা বাস স্টপেজ। এখান থেকে মধুমতি নদীর পুরণো ফেরিঘাটে যেতে পথেই মাঝাইল গ্রাম। আর এ গ্রামের বর্ধিষ্ণু মুসলিম পরিবারে ১৯১৮ সালের ১০ জুন কবির জন্ম। বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন পুলিশের ইন্সপেক্টর। মায়ের নাম রওশন আক্তার।

বাবা পুলিশের কর্মকর্তা হওয়ায় মাঝাইল গ্রামের বাড়িটি এক সময় দারোগা বাড়ি হিসেবে পরিচিত থাকলেও এখন সবাই কবির বাড়ি বলেই চেনেন। বাড়িটির বেশ আগে মূল সড়কের পাশে কবির নামে ফটোক, বাড়ির সামনে ফলক, ঝকঝকে গোলঘর গ্রামের সোঁদাগন্ধ জড়ানো মাটিতে কবির অধিকারের প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। তবে অল্প সময়ের ব্যবধানে সেই কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হতে হবে এমন শঙ্কা গ্রামের সকলের।

সরজমিনে মাঝাইল গ্রামে গিয়ে কবির বাড়ির প্রধান ফটোকে দাঁড়াতেই দেখা যায় মধুমতি নদী। সেখানে দিনরাত কাজ করছেন রেল কোম্পানীর শ্রমিকেরা। ইতোমধ্যেই নদীর বুকে জায়গা করে নিয়েছে মোটা কংক্রিটে গড়া ভারি ভারি পিলার। তার উপর দিয়ে দূরের পথ থেকে ধেয়ে আসবে রেলগাড়ি। তাই ছেড়ে দিতে হবে পথ। যে পথে বিলিন হওয়ার শঙ্কা কবির বাড়িটি।

টিনের ছাউনীতে শালকাঠে ঘেরা শতবর্ষ আগে তৈরি যে ঘরটিতে কবি জন্মেছেন সেটি ঘিরে এখন বসবাস করছেন কবির ভাই মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মারুফ আহমদ মাক্কু এবং সৈয়দ মোস্তাক আহমদের পরিবারের সদস্যরা। উভয় পরিবার কবির ঘরটিকে ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে রেখে দিলেও এত বছরে সেখানে চলেনি কোনো সংস্কার কাজ।
ঊনচল্লিশ বন্দরের তিনকক্ষ বিশিষ্ট ঘরটির সামনে-ভিতরে ঝোলানো রয়েছে কবির নানা রকম ছবি। কিছু বই। আছে কবি পরিবারের ব্যবহৃত পুরণো শালকাঠের খাট। তবে অনেক জায়গাতে ধরেছে ঘুন। টিনের চালে জমেছে ভারি মরিচা। বর্ষার পানি পড়ে মেঝেতে জন্মেছে শ্যাওলা।

বাড়িতে গিয়ে দেখা মেলে কবির ছোট ভাই প্রয়াত সৈয়দ মোস্তাক আহমদের সত্তোরোর্ধ স্ত্রী ফাতেমা বেগমের সাথে। কবির আট ছেলে-তিন মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে এবং এক মেয়ে বেঁচে আছেন। থাকেন ঢাকাতে। নিজের ছেলেরাও ঢাকায় বসবাস করেন। বাসযোগ্য পাকাঘর থাকলেও কবির ঘরটি আকড়ে বসবাস করছেন বলে জানালেন তিনি।
ফাতেমা বেগম বলেন, সরকার কবির বাড়ির উপর দিয়ে রেল লাইন করতে চায়। মরে যাবো তবু ঘর ভাঙতে দেবো না। ছেলেরা দূরে, এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকেই পাহারা দিতে হচ্ছে। ডিসি অফিস থেকে জায়গা অধিগ্রহণ করতে নোটিশ নিয়ে এলেও ফেরত দিয়েছি। অথচ রেল সড়কের গতিপথ একটু সরিয়ে নিলেই বাড়িটি টিকে যেতে পারে।

এ গ্রামের পাঠশালাতেই কবির শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে কোলকাতা মডেল এমই স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে। সে সময় কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রাথমিক জীবনে কবিত্ব বিকাশে যিনি ব্যাপক উত্সাহ দিয়েছেন। ১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক এবং ১৯৩৯ সালে কোলকাতার রিপন কলেজ হতে আইএ পাস করেন। সেখানে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শন ও সিটি কলেজ থেকে পরে ইংরেজীতে অনার্স করেন। এ সময় তিনি ভারতবর্ষের বিখ্যাত কমরেড মানবেন্দ্র নাথ রায় সান্নিধ্যে গিয়ে বাম রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়লেও পরবর্তিতে সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসেন।

১৯৪৩ সালে আইজি প্রিজন অফিসে চাকরির মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। পরে ১৯৪৮ সালে কোলকাতা থেকে ফিরে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সেখানে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ‘ছোটদের খেলাঘর’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে কবির “মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা” গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরদার ছিলেন। মাসিক সওগাত পত্রিকায় (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৪৭) রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে নিবন্ধ লেখেন। বায়ান্নর রক্তাক্ত ঘটনার পর রেডিওতে কর্মরত শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হালিম চৌধুরীদের নিয়ে ধমঘটেও যোগ দেন তিনি।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, জাগরণের কবি, জাতিসত্তার কবি ফররুখ আহমদ তার প্রথম প্রকাশিত ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থের জন্যেই বাংলা সাহিত্যের ভূবনে, মানুষের মনিকোঠায় অমরত্ম নিয়ে বেঁচে থাকবেন। এটির প্রকাশক ছিলেন কবি বেনজীর আহমদ। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন।
কবিতাটির কয়েকটি পঙতি-“কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা/ নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা/ দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা/ তবু জাগলে না? তবু, তুমি জাগলে না/ সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে ডাকে জাহাজ/ অচল ছবি সে, তসবির যেন দাঁড়ায়ে রয়েছে আজ।”

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিদের মধ্যে কাব্যনাটক রচনার পথিকৃত তিনি। তার ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক। সনেট ও গদ্য কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন কবি। তার অনেক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে-‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘সিরাজাম মুনিরা’, ‘নৌফেল ও হাতেম’, ‘মুহূর্তের কবিতা’, ‘ধোলাই কাব্য’, ‘হাতেম তায়ী’, ‘নতুন লেখা’, ‘কাফেলা’, ‘হাবিদা মরুর কাহিনী’, ‘সিন্দাবাদ’, ‘দিলরুবা’ উল্লেখযোগ্য।

কবি স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমী (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পদক (১৯৬৫), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬), একুশে পদক (১৯৭৭-মরণোত্তর), স্বাধীনতা পদক (১৯৮০-মরণোত্তর)।

শেষ বয়সে কবি ফররুখ আহমদকে চরম দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ঢাকা বেতার থেকে চাকরি চলে যায়। এক ছেলে ডাক্তারি পড়ছিল, টাকার অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। চিকিৎসার অভাবে এক মেয়ে মারা যায়। ১৯৭৪ সালের ১৯শে অক্টোবর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন কবি। এ সময় দাফন নিয়ে সমস্যায় পড়েন কবির পরিবার। সরকারিভাবে কোন জায়গা পাওয়া যায়নি। অবশেষে কবি বেনজীর আহমদ তার শাহজাহান পুরের পারিবারিক গোরস্থানে কবিকে দাফনের সুযোগ দেন। সেখানেই ঘুমিয়ে আছেন জাগরণের কবি সৈয়দ ফররুখ আহমদ।

বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবি ফররুখ আহমদের স্মৃতিধন্য বাড়িটি কেবল একটি স্থাপনা নয়, বরং বাংলার সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। এই ঐতিহ্য রক্ষায় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখা জরুরী বলে মনে করেছেন অনেকেই।

কবি ফররুখ স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি সৈয়দ রিপন আহমদ বলেন, কবির বাড়িটি রক্ষার্থে আমরা বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন সহ জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বাস দেয়া হলেও সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে কবির ছেলে অবসারপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান বাচ্চু বলেন, সরকার বাড়িটি সংরক্ষণ করে পর্যটন ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তুলতে পারে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস্য হয়ে থাকবে। সেক্ষেত্রে আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা দিতে চাই।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology