আজ, মঙ্গলবার | ১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | রাত ১০:২৬


বিজয়ের ৫৫ বছর: রাষ্ট্র আছে, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি কোথায়?

আবু বাসার আখন্দ : ১৬ ডিসেম্বর—রক্তস্নাত বিজয়ের ৫৫তম বার্ষিকী। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বের দিন। অথচ এই বিজয় দিবসে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্নটি আবারও সামনে আসে—যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আদর্শের ভিত্তিতে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ, সেই মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি আজ কোথায় দাঁড়িয়ে?

১৯৭১ সালে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অগণিত প্রাণ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে দুই যুগের শোষণ-বঞ্চনার। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পর আজ রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা বলছে—মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক শক্তির রাজনীতি দেশে নিষিদ্ধ, আর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্তরাধিকারীরা নানা কৌশলে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত।

প্রশ্ন জাগে—এটাই কি বিজয়ের অর্জন?

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, তার পুনরুত্থান ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৯১ হাজার ৫৪৯ পাকিস্তানি সৈন্যের প্রকাশ্য আত্মসমর্পণ ছিল বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা। কোনো দেনদরবারে নয়, কোনো কূটচালে নয়—এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই বিজয়ের মহানায়ক ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশের জন্ম কল্পনাই করা যায় না।

কিন্তু বিজয়ের ৫৫ বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দর্শন রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ কেবল দিবসকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ; বাস্তব রাজনীতিতে তার প্রতিফলন ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

এর চেয়েও উদ্বেগজনক বাস্তবতা হলো—যে শক্তিগুলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছিল, যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসন আজ আর গোপন নয়। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ পরোক্ষে—তারা প্রশাসন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় বয়ানের ভেতরে জায়গা করে নিচ্ছে। অন্যদিকে তাদের হাতে নিগৃহিত হচ্ছেন দেশের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষেরা।

নিঃসন্দেহে বিজয়ের ৫৫ বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি বড় অর্জন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই বিচার কি কেবল অতীতের দায় মেটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি ভবিষ্যতের জন্য কোনো নৈতিক ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছে? যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়, তখন সেই বিচারও নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা, গণঅভ্যুত্থান থেকে ৭ মার্চ—এই দীর্ঘ ও ধারাবাহিক সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চের কালরাতে গণহত্যা শুরুর পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তাঁর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেও রাজনৈতিক বৈধতা ও নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধুই—এটাই ঐতিহাসিক সত্য।

অপ্রিয় হলেও সত্য, আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপনের প্রবণতা বাড়ছে। দলীয় ও ক্ষমতার স্বার্থে ইতিহাস পুনর্লিখনের চেষ্টা চলছে। এই বিকৃতি শুধু অতীতের প্রতি অবিচার নয়, ভবিষ্যতের জন্যও এক ভয়াবহ সংকেত।

এ কারণেই বিজয় দিবস আজ শুধু উৎসবের দিন নয়—এটি আত্মসমালোচনারও দিন। রাষ্ট্র আছে, পতাকা আছে, মানচিত্র আছে; কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—রাষ্ট্র পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের দর্শন কতটা কার্যকর?

যদি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক আদর্শ নিষিদ্ধ হয়, যদি স্বাধীনতাবিরোধীরা পুনর্বাসিত হয়, তবে বিজয় কি কেবল একটি ঐতিহাসিক দিবসেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

৫৫ বছরে এসে বিজয়ের সবচেয়ে বড় লড়াই এখন আর রণাঙ্গনে নয়—এটি রাজনীতি, রাষ্ট্রচিন্তা ও ইতিহাস রক্ষার লড়াই। এই লড়াইয়ে পরাজিত হলে, মানচিত্রে বাংলাদেশ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology