আজ, রবিবার | ২৬শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | রাত ১০:২০


শামসুন নাহার আহমেদ: মাগুরার এক প্রথমা কন্যার কথা

লায়লা আরিয়ানি হোসেন : রত্নগর্ভা মা বেগম ওয়াজেদা আহমেদের  ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয়, একমাত্র কন্যা শামসুন নাহার আহমেদ, মাগুরায় যাকে মুকুল দিদি বলে সবাই জানে।দুই ভাইয়ের পরে তার জন্ম এবং ছোটবেলার কিছু সময় থেকেছেন দিল্লিতে, যেহেতু তাঁর বাবা জহুর আহমেদ তৎকালীন অবিভক্ত ভারত সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর, চলে আসেন  মাগুরায়। পরিবারের সঙ্গে পারনান্দুয়ালি গ্রামে থাকতেন তখন। সেখান থেকে মাগুরা আসতেন স্কুল করতে। মাধ্যমিকের পরে তাঁকে তাঁর মা পাঠিয়ে দেন কলকাতার লেডি ব্রেবর্ণ কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার জন্য। সেখানে থাকাকালীন তাঁর পরিচয় হয় সেই সময়ের অনেক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে। একটা সময় তিনি জড়িয়ে পড়েন বাম রাজনীতিতে এবং বাম রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সে সময় তিনি গান শিখতেন কলিম শরাফির কাছে।

উচ্চ মাধমিক পাশ করার পর তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে লাহোর, করাচী রাওয়ালপিণ্ডির মতো শহরে থাকা শুরু করেন। সেই সময় তিনি যোগ দেন রেডিও পাকিস্তান করাচি কেন্দ্রে। সেখানে তিনি সংবাদ পাঠ করতেন, নজরুল সংগীত গাইতেন, সংবাদ সম্পাদনা ও অনুবাদের কাজ করতেন। সেখানে তিনি  কৃতিত্বের সাথে কয়েকবার শ্রেষ্ঠ সংবাদ পাঠক নির্বাচিত হন। সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও পুরস্কৃত হন। সেই সময় তার কাছে বিবিসি’তে কাজ করার প্রস্তাবনা আসে। রেডিওতে কাজ করার সুবাদে তিনি সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহসহ আরো অনেক গুণী ব্যাক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসেন।

রেডিও পাকিস্তানে যখন তিনি কাজ করতেন তখন পাকিস্তানে গড়ে তোলা হয় নজরুল একাডেমি। নজরুল একাডেমিতে গান শেখানো, শেখা, চর্চা  ও অন্য সাংগঠনিক ক্ষেত্রে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিলো। তিনি দুই ছেলের মা ছিলেন। বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পর, ১২বছর পাকিস্তানে থাকার পরে তিনি চলে আসেন মাগুরায়। মাগুরায় এসে তিনি সেখানে স্নাতক পরীক্ষা দেন এবং পাশ করে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মুন্নুজান হলে আবাসিক ছাত্রী ছিলেন। মুন্নুজান হলে থাকার সময় তিনি আবারো ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও। সেই সুবাদে তার সাথে পরিচয় হয় অনেক বরেণ্য ব্যক্তিদের সাথে। তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ’র মতো মানুষদের।

গুণী মানুষের সান্নিধ্যে তাঁর বাংলা বিভাগে লেখাপড়ার সময় রাজশাহীর মতিহার ক্যাম্পাসে তিনি তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু সময় কাটান। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গণে কৃতিত্ব ও সুনামের সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চলতে একটা সময় তিনি হয়ে ওঠেন সকলের অতি প্রিয় মুকুল আপা। মুন্নুজান হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে। সেই একই সময়ে তার জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন প্রখ্যাত লেখিকা সেলিনা হোসেন। এভাবেই তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেন।

তিনি মাগুরায় ফিরে এসে মাগুরার বর্তমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রথম মহিলা লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। যদিও তারঁ যোগ দেয়া নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত ছিলো। কোনো মহিলা লেকচারার কেন কলেজে পড়াতে আসবেন, কারণ তখনকার সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট এটা স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু তিনি পিছিয়ে যাওয়ার মানুষ নন। তাঁর সমর্থনে ছিলেন ততকালিন অধ্যক্ষ এবং কমিটির কয়েকজন সদস্য। তিনি সেখানে যোগ দেন এবং সাফল্যের সাথে সেখনে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। সেই সময়ে তাঁর ছাত্র ছিলেন যারা, তারা এখন অনেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তারা শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ করে থাকেন। কলেজের সবাইকে সাংস্কৃতিক দিকে মনযোগী ও সক্রিয় করতে তাঁর ভুমিকা ছিল।

তিনি সাংস্কৃতিক অনেক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গণে সক্রিয় থাকা ছিলেন তাদের পারিবারিক প্রথার মত। সেই ধারাবাহিকতায় মাগুরায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রাথমিক কার্যক্রম সম্পন্ন হত তাঁর পরিবার থেকেই। তিনি সকলকে নিয়ে খুবই সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানের মহড়া দিতেন। তিনি সেই সময়ে আরো অনেক মেয়েকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশে উৎসাহী করে তুলতেন। তাঁর প্রেরণায় অনেক মেয়ে শিল্পী এগিয়ে আসেন।

মাগুরায় ললিতকলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর বড় ভূমিকা ছিলো এবং তিনি সকলের সাথে একযোগে কাজ করেন,  প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন তিনি ছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং অনুষ্ঠানে অংশ নিতে উপস্থিত থেকেছেন। চিত্রনাট্য, লেখা থেকে মঞ্চ সজ্জা, পোশাক পরিকল্পনা থেকে স্টেজ রিহার্সাল, বিভিন্ন কাজে সরাসরি অংশ নিতেন। তাঁর কাছে যারা গান শিখেছেন তারাও তাঁর অত্যন্ত গুণমুগ্ধ ছিলেন। তারমধ্যে মিহিরলাল কুরি, চন্দ্রপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এদের নাম উল্লেখযোগ্য।

এরপর তিনি কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন। সিদ্ধান্ত নেন নতুন করে সংসার জীবন শুরু করার। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী স্বামীর ব্যবসায় মনোযোগ দেন ও ঢাকায় থাকা শুরু করেন। ঢাকা থাকাকালিন তিনি বিজনেস ডেভলপমেন্ট সেন্টার থেকে ডিপ্লোমা করেছেন এবং তিনি স্বামীর সাথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সফর সঙ্গী হয়েছেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাজসেবামূলক এবং ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। এরই মাঝে তাদের সংসারে আসে এক কন্যা সন্তান।

এর পরে একটা সময়ে তিনি আবার মাগুরায় ফিরে আসেন। যোগ দেন কামারখালি কলেজে। তিনি যখন এই কলেজে যোগ দেন কলেজটি ছিলো কো-এডুকেশন কলেজ; যেখানে সহশিক্ষা প্রচলিত ছিলো। একটি কো-এডুকেশন কলেজে মহিলা প্রিন্সিপাল, বাংলাদেশে খুব কমই দেখা যেত। কিন্তু তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই দায়িত্ব ভার বুঝে নেন। কলেজের উন্নয়নের জন্য তিনি সাধ্যমত সকল প্রকার উদ্যোগ যেমন: কমনরুম, লাইব্রেরী, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা, বিজ্ঞান গবেষণাগার স্থাপন করেন। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার জন্য তাঁর ভূমিকা ছিলো অনস্বীকার্য। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীরা যেন পড়াশোনা বন্ধ না করে সে ব্যাপারে কাউন্সিলিং করতেন, অভিভাবকদের  সাথে কথা বলতেন, নানা রকম পরামর্শ দিতেন। মেয়েদের যেন অন্তত এখানে যতটুকু পর্যন্ত পড়ানো যায় ততটুকু যেন পড়ান,সেই অনুরোধ করতেন। সেই সময় ঐ কলেজে স্নাতক পর্যন্ত পড়ানো হত। মেয়েদের কলেজে উঠলেই বিয়ে না দেয়ার পরামর্শ দিতেন।

আশেপাশের গ্রামের অনেক মেয়েও ঐ কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষ করেন এবং অনেক মহিলা লেকচারার কলেজে পড়ানোর জন্য যোগ দেন। কলেজটিকে এমপিওভুক্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। তিনি যখন জানতে পারেন ঐ এলাকারই  ছেলে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ। তখন তিনি কলেজটিকে মুন্সী আব্দুর রউফের নামে করানোর জন্য বড়সড় ভূমিকা রাখেন। মূলত তার উদ্যোগেই, এলাকাবাসীর  সহযোগিতায় প্রথম বীরশ্রেষ্ঠর নামে কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ কলেজ, কামারখালি। বর্তমানে এই কলেজ সরকারি কলেজ।

সমাজ সেবা, শিক্ষা সংস্কৃতি, এইসব ক্ষেত্রে তিনি সব সময় সক্রিয়। পরবর্তীতে তিনি ১৯৯১ সালে এই এলাকার প্রথম মহিলা সংসদ সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে যোগ দেন। তিনি মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল এই তিন আসনে যিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন। জাতীয় সংসদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এর বিশেষ কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। এই কারণে দেশের অনেক স্থানে সফর করেন। মাগুরায় মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেয়া শিক্ষানুরাগীদের মাঝে তিনি একজন। সংসদ সদস্য থাকাকালীন এলাকার উন্নয়নে সক্রিয় ভুমিকা রাখেন। বিশেষ করে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা, শিক্ষা সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল বেশী। নারীর ক্ষমতায়নে সেলাই মেশিন, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করেন। নারীদের সক্রিয় রাজনীতি, সংস্কৃতিতে অংশ নিতে সব সময় উৎসাহ দিতেন। সংসদ সদস্য থাকাকালীন তিনি ইরান, মিশর এবং যুক্তরাজ্য সফর করেন।

মাগুরার এই কন্যা, যিনি অনেক ক্ষেত্রে প্রথমা, অনেক ক্ষেত্রে অন্যতমা, আজকের প্রজন্মের এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করেছিলেন তিনি। শিক্ষা সংস্কৃতি রাজনীতি সমাজসেবা, সবখানে থেকেছেন যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখতেন। বেসরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছেন একটি ডিপ্লোমা। তিনি পরবর্তীতে ঢাকায় থাকতেন, মাঝে মাঝে মাগুরায় যেতেন। আর কোনো কাজে নতুন করে জড়িত হননি। বাসায় বসেই লেখালেখি করতেন, পড়াশুনা করতেন। ২০১৫ সালে তিনি একটি বই লিখেন। বইটির নাম “আমার সময়”। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা ছিল। তিনি ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখে মৃত্যু করেন।
লায়লা আরিয়ানি হোসেন, উপস্থাপক, বাংলাদেশ বেতার, স্ক্রিপ্ট ও কন্টেন্ট লেখক, লাইফ কোচ, মেডিটেশন প্রশিক্ষক।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology