মাগুরা প্রতিদিন: ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ সমাবেশে কয়েকটি মিলিটারি-গ্রেডের গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। সেই হামলায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত ও স্প্লিন্টারের আঘাতে ৩শ’র বেশি জন আহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান। আহতদের মধ্যে অনেকের জীবনযাপন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেও, কানে আঘাত পান, যার প্রভাবে আজ পর্যন্ত তিনি ভুগছেন।
আক্রমণের লক্ষ্যটি সহজ ছিল: শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নির্মূল করা। এটি বাংলাদেশের মাটিতে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার একটি ছিল। এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলা, কারণ এটি রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট ছিল এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করার জন্যই এই হামলা চালানো হয়।
সংক্ষেপে বলা যায়, হামলাটি চালায় হরকাতুল জিহাদ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন (হুজি)। এরসাথে বিএনপি’র তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান, সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি’র উপ-শিক্ষামন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জামায়াতে ইসলামের সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এবং আইন প্রণয়নকারীরাও সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িত ছিলো। এছাড়া, কাশ্মিরভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, হিজবুল মুজাহিদিন, তেহরিক জিহাদ-ই ইসলাম, লস্কর-ই-তৈয়বা এবং মিয়ানমার ভিত্তিক রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি গোষ্ঠি এর সাথে জড়িত ছিল।
হামলার মুল উদ্দেশ্য:
চার্জশিট, বাদীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) প্রধান মুফতি হান্নান এবং খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ও তৎকালীন এপিএস -১ সাইফুল ইসলাম ডিউকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এটি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এই আক্রমণের উদ্দেশ্য এমন ছিল:
খালেদা জিয়ার ছেলে ও বিএনপি’র তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান তারেক রহমান, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করে। এই কাজের জন্য হুজি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। অবশ্য, হুজিদের বিকৃত মতাদর্শের কারনে তাদের খুব বেশি জোরাজুরি করতে হয়নি। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্বের জন্য শেখ হাসিনাকে তারা ‘ইসলামের শত্রু’ বলে বিবেচিত করে।
হামলার কয়েকদিন আগেই গুলশানে ‘হাওয়া ভবন’ নামে পরিচিত তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিলো। তারেক রহমান এবং তার অন্যান্য সহযোগীদের সাথে হুজি সন্ত্রাসীরা সেখানে সাক্ষাৎ করে নির্দেশনা গ্রহণ করে এবং সার্বিক প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করে। এই সহযোগীদের যার মধ্যে রয়েছেন:
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিব ও তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআই এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম ও ডিজিএফআই এর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজর নূর চৌধুরীও সেই হামলার ঘটনায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবনে বিএনপি’র সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ হুজি আক্রমণকারীদের এবং বিএনপি-জামায়াতের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। হাওয়া ভবনে ছাড়াও মোহাম্মদপুরের হুজি’র আস্তানায় এবং ধানমন্ডিতে বিএনপি’র উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসভবনে অন্যান্য পরিকল্পনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় তাজউদ্দীন নামের একজন হুজি সদস্য হত্যাকারীদের কাছে গ্রেনেড সরবরাহ করে।
মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও দেখা যাবে এই লিংকে:
https://www.facebook.com/awamileague.1949/videos/882176331988715/
এই হামলায় আরো একজন অভিযুক্ত আসামি পাকিস্তানী সন্ত্রাসী আবু ইউসুফ এক স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিতে বলেছে, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-জিহাদি (টিজেআই) এর নেতা মুজফফর শাহ গ্রেনেডগুলো তাজউদ্দিকে সরবরাহ করে। কিভাবে হুজিরা বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর থেকে সমর্থন নিশ্চিত করে সে বিষয়েও কথা বলেন।
অপারেশন: ‘লাইট স্ন্যাক্স ফর শেখ হাসিনা’
হামলার একদিন আগে, ২০শে আগস্ট হুজি হত্যাকারীরা, কাজল এবং আবু জান্ডাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামলার স্থান পরিদর্শন করেন। অপারেশনটির নাম ছিল ‘লাইট স্ন্যাক্স ফর শেখ হাসিনা’ (শেখ হাসিনাকে নাশতা করানো)। ২১শে আগস্ট, তারা বাড্ডায় একটি পুর্বনির্ধারিত বাড়িতে সাক্ষাৎ করে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে হামলাকারী কাজল ও আবু জান্দালের নেতৃত্বাধীন মোট ১২ জন ওই ঘটনায় অংশ নেবে। তারপর তারা একসঙ্গে নামাজ পড়বে এবং মধ্যাহ্ন ভোজ করবে। চূড়ান্ত বৈঠকের পর মাওলানা সাঈদ জিহাদের বক্তৃতা দেন। এরপর মুফতি হান্নান ১২ জন হামলাকারীর কাছে ১৫টি গ্রেনেড হস্তান্তর করেন।
আলোচনা অনুযায়ী আসরের নামাজের পর তারা সবাই গোলাপ শাহ মাজারের কাছে ফিরে গেল। এরপর তারা ট্রাকের চারপাশে অবস্থান নেয় যেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনার বক্তব্য শুরু হলে আবু জানদাল প্রথম গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করে। তারপর, প্রত্যেকে নিজের গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ওই স্থান ত্যাগ করে। আগে থেকেই নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ায় হামলাকারীরা দিবালোকে অপরাধ করে পালিয়ে যেতে পারে।
২০০৪-০৬: তদন্ত ও বিচারকাজে বাধা
যেহেতু জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় সরকার ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আক্রমণের পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলো এ কারণেই ক্ষমতায় থাকাকালীন ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িতদের সঠিক তদন্ত না করার পক্ষে ছিলো। প্রকৃতপক্ষে, তারা প্রক্রিয়াটির বিপরীতে কাজ করে তদন্তটি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলো এবং আক্রমণকারীদের বিচার থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করেছিল।
ওই হামলার সব ঘটনাগুলো একদমই স্পষ্ট ছিল। সাধারণত, স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সব ধরনের সভা সমাবেশে আওয়ামী লীগের নিরাপত্তা বজায় রাখতে কাজ করতো। এমনকি নিকটবর্তী ভবনগুলোর ছাদ থেকেও তারা নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করতো। কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট, স্বেচ্ছাসেবকদের আশপাশের ভবনের কোন ছাদে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।
গ্রেনেড বিস্ফোরণের পরপরই, পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং যেসব নেতাকর্মীরা আহতদের উদ্ধার করছিলো তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। ওই সময়ই তারা হামলাকারীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। হামলার পরবর্তী সময়ে সেখানে থেকে ঘটনার আলামত ও প্রমাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ওই এলাকা বন্ধ করা হলেও সেখানকার প্রমাণ ধ্বংস করতে ওই এলাকা সাবানমিশ্রিত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়। এমনকি উদ্ধারকৃত গ্রেনেডগুলোও সংরক্ষণ না করে ধ্বংস করা হয়।
শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য, তখন বিএনপি-জামায়াত সরকার বিচারপতি জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে এক ব্যক্তি দ্বারা জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করে। অত্যন্ত হাস্যকরভাবে তদন্তকাজ শেষ করে এই কমিশন উপসংহার টেনেছিলো যে ‘বিদেশি ও স্থানীয় শত্রুরা’ এই হামলা চালিয়েছিল। দুই বছর পরে একই বিচারপতি জয়নাল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উন্নীত হন, সম্ভবত তার ‘রিপোর্ট’ এর জন্যই তাকে পুরস্কৃত করা হয়।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিচার প্রক্রিয়ার অবসান ঘটানোর মূল কৌশলগুলির মধ্যে একটি ছিল নির্দোষ ব্যক্তিদেরকে জড়িত করা। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষুদ্র অপরাধী জজ মিয়া, ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মিথ্যা অভিযোগে জড়িত ছিল। ২০০৫ সালের ১০ জুন ফৌজদারি তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তারা জজ মিয়াকে তার নিজ বাড়ি গ্রেফতার করে। তিন বছর পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। একই রকম আরেকজন ব্যক্তি ছিলেন যার নাম পার্থ, যাকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বলা হয়। ওই নির্যাতনের কারণে এখনও পোস্টট্রমাটিক বিষন্নতায় ভুগছেন তিনি।
এখানে জজ মিয়ার কঠোর পরীক্ষার ভিডিও দেখুন:
https://www.facebook.com/awamileague.1949/videos/690872401102621/
হামলাকারীদের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও আক্রমণকারী সন্ত্রাসী তাজউদ্দিন ছিলেন বিএনপি’র উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই। তারেক রহমানের নির্দেশে খালেদা জিয়ার ভাতিজা ও তার এপিএস -১ সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ অন্যদের বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। এরা সবাই ডিজিএফআই এর মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন।
ওই হামলার অন্যতম প্রধান আক্রমণকারী হুজি প্রধান মুফতি হান্নান। ২১শে আগস্ট হামলায় জড়িত থাকলেও বিএনপি-জামায়াত সরকারের ক্ষমতায় থাকায় হান্নান ও তার সহযোগী বিপুলকে গ্রেফতার করা হয়নি। কিন্তু, অন্য মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর তারা ২১শে আগস্ট হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
২০০৬-২০১৮: বিচারের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা
২০০৬-০৬ সালে দুই বছর ধরে সিআইডি মামলার চার্জশিট দাখিল করতে ব্যর্থ হয়েছিলো, তবে বিএনপি নেতারা বেশ কয়েকবার দাবি করেছিলেন যে তদন্ত শেষ হওয়ার পথে এবং সবকিছু প্রকাশ করা হবে। তদন্তকারীরা হামলার পেছনে থাকাদের খুঁজে বের করার পরিবর্তে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকৃত অপরাধীদের রক্ষা করার জন্য তদন্তকে ভুল পথে নিয়ে যায়।
২০০৭ সালের জুলাই মাসে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে ফৌজদারি তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) একটি নতুন তদন্ত শুরু করে। ২০০৮ সালের ১১ই জুন সিআইডি হুজি নেতা মুফতি হান্নান ও সাবেক বিএনপির উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে একটি চার্জশিট দাখিল করে। সেখানে বিএনপি-জামায়াত সরকারের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়া হয়।
যাইহোক, তদন্তকারীরা হামলার মাস্টারমাইন্ড এবং আক্রমণে ব্যবহৃত গ্রেনেডের উৎস সনাক্ত করতে পারেনি। এরপর, ২০০৯ সালের ২২শে জুন, গ্রেনেড সরবরাহকারী এবং আক্রমণের পৃষ্ঠপোষকদের সনাক্ত করার জন্য প্রসিকিউশন আরও তদন্তের চেষ্টা করেছিল। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট, আদালত তদন্তের আদেশ দেন এবং নতুন একজন সিআইডি কর্মকর্তাকে এই মামলার দায়িত্ব দেয়া হয়।
অবশেষে ২০১১ সালের জুলাই মাসে সিআইডি একটি নতুন চার্জশিট জমা দেয়, যাতে দেখা যায় প্রভাবশালী বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা, পুলিশ, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) ২১শে আগষ্ট হামলায় জঙ্গি সংগঠন হুজির সাথে সম্পৃক্ত ছিলো।
তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং সাবেক জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ আসামির বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট জমা দেয়া হয়। ২০১২ সালের মার্চে, ট্রাইব্যুনালে তারেকসহ ৫২ জন আসামিকে হত্যা মামলার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, যেখানে ৩৮ জনকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের অধীনে দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়।
হত্যার ঘটনায় ১১জন আসামি বিস্ফোরক মামলায় জড়িত ছিল না। এদের মধ্যে তিনজন সাবেক আইজিপি, সাবেক তিন সিআইডি কর্মকর্তা, সাবেক দুই সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ডিউক এবং দুই সাবেক সেনা কর্মকর্তা এটিএম আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার অন্তর্ভুক্ত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় জামায়াত নেতা মুজাহিদের ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। একইসাথে সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার মামলায় মুফতি হান্নান ও আরেকজন হুজির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সুতরাং, তাদের নাম ওই মামলা থেকে দেয়া হয়।
গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বোমা বিস্ফোরণের দুই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বর্তমানে ৪৯ জন অভিযুক্ত এবং অনেকের বিচার হচ্ছে। আটজন এখন জামিনে আছেন, আর তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক, আর সাবেক বিএনপি মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ২৩ জন কারাগারে।
মামলার কার্যধারা:
জঘন্যতম এই হামলার মামলায় সব পক্ষকে বিদ্যমান সব আইনি সুবিধা দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণা করেন। বিচারিক আদালতের রায়ের পর এখন হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির অপেক্ষায়।
বিচারিক আদালতের রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন দুই শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ জন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) সদস্য। এছাড়া রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও অপর ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড দেয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ জন
বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। তারা হলেন: সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (সম্প্রতি মারা গেছেন), হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১৯ জন
বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। তারা হলেন: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও আরিফুল ইসলাম আরিফ, জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।
বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন
মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, জোট সরকার আমলের তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমীন।
খালেদা জিয়ার ভূমিকা:
বাংলাদেশের মাটিতে নিন্দাজনক হামলার ঘটনার পর খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার পরিবর্তে নিজের সত্যিকারের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সংসদে সংসদে হাস্যরস করে মন্তব্য করেছিলেন: ‘কে তাকে হত্যা করতে চায়?’ এবং আরও বলেছিলেন যে শেখ হাসিনা তার নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে করে জনসভায় গ্রেনেড নিয়ে এসেছিলেন। এ সময় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের মধ্যে মতামতের একটি পুনরাবৃত্তিমূলক বিষয় ছিল। তারা বলেছিলো আওয়ামী লীগ বিদেশে সহানুভূতি অর্জনের জন্যই নিজের লোকদের উপর হামলা চালায়।
খালেদা জিয়ার আরো একটি বিতর্কিত ভূমিকার স্পষ্ট প্রকাশ পায়, যখন ২১শে আগস্ট হামলার তদন্ত করার জন্য খালেদা জিয়াকে তৎকালীন ডিজিএফআই প্রধান রুমী খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কিন্তু খালেদা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি যদি এটি নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না যে তিনি সরাসরি এতে জড়িত ছিলেন, অন্তত এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিলো যে খালেদা জিয়া জানতেন যে তারেক রহমান ওই ঘটনায় জড়িত ছিলেন। আর এ কারণেই তিনি তার পুত্রকে আগে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, তারপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের কল্যানে কাজ করার অঙ্গীকারের দিকে দৃষ্টি দেন।
সূত্র : albd.org