মাগুরা প্রতিদিন ডটকম: এ বছরের ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে ‘জয়বাংলা’ ইস্যুতে বিশেষ আলোচনা পর্বে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। হাসানুল হক ইনু এমপি’র সেই বক্তব্য জনমনে দারুণ আগ্রহ তৈরি করে। ইতিহাসের অমোঘ সত্য তুলে ধরায় সেদিন হাসানুল হক ইনু এমপির বক্তব্যকে টেবিল চাপড়িয়ে সমর্থন জানান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই বক্তব্য এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো।
মাননীয় স্পীকার,
আপনাকে ধন্যবাদ।
জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বের ধাপে ধাপে স্বাধিকার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের পথ অতিক্রম করে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে উন্নিত হয়। এ সংগ্রামের ধারায় ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারিত হয় এবং জাতীয় রণধ্বনি হয়। ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় গড়ে দেয়। সমগ্র জাতিকে এই রণধ্বনি একাট্রা করতে সাহায্য করে। শুরুতেই আমি তাই যাঁরা এই রণধ্বনি উচ্চারণ করেন, যাঁরা জনপ্রিয় করতে লাগাতার কাজ করেন। তাঁদের, সেই তরুণ বীরদের আমি শ্রদ্ধা জানাই।
মাননীয় স্পীকার,
বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ পরামর্শে, পৃষ্ঠপোষকতায়, সমর্থনে, সহযোগিতায় সিরাজুল আলম খান, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, প্রয়াত কাজী আরেফ আহমেদসহ ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা ১৯৬২ সাল থেকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করছিলেন। এই ধারাবাহিক সংগ্রাম ও প্রক্রিয়ার আমি প্রত্যক্ষ অংশীদার, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বাক্ষী।
মাননীয় স্পীকার,
পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর প্রধান গেরিলা প্রশি¶ণ কেন্দ্রের প্রধানের দায়িত্ব পাই এবং প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পাই। আমার অধীনে দশহাজার যোদ্ধা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধ করে। সে কথা থাক। যে কাজের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের আয়োজনে একটি কর্মী সভা ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনের পাশে অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। সেই কর্মী সভায় ১৭ই সেপ্টেম্বরের শিক্ষা দিবস পালনের প্রস্তুতি চলছিলো। ঐ সভায় উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রলীগ নেতা রায়হান ফেরদৌস মধু’র ভাষ্য অনুযায়ী, কর্মীসভার এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ সংগঠক আফতাব আহমেদ সবাইকে চমকে দিয়ে স্লোগান দিলেন ‘জয়বাংলা’। এই শ্লোগান জনপ্রিয় করতে ছাত্রলীগের শহীদ চিশতি, আ ফ ম মাহবুল হক, গোলাম ফারুক, একরাম, বুয়েটের ইউসুফ সালাউদ্দিন, এনামুল হকসহ অনেক ছাত্রনেতা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
খুবই অল্প কয়েকদিনের ভিতরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ইডেন গার্ল্স কলেজ, বকসি বাজারের বদরুন্নেসা কলেজ-এর ছাত্রলীগের কর্মীদের কন্ঠে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি, ধ্বনিত হতে থাকে। সেই সময় আমি দেখিছি দূর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ভেতরে কতিপয় কিছু নেতা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের বিরোধিতা করেছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, অনুমোদনে এই স্লোগান জনপ্রিয় হতে থাকে। আবার ছাত্রলীগের বাহিরে কিছু মহল ‘জয়বাংলা’কে খাটো করার জন্যে ‘জয় সর্বহারা’ স্লোগান তুলেছিলো। কিন্তু হালে পানি পায়নি। বরং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান জোয়ারের প্লাবনের মতই গোটা দেশকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
মাননীয় স্পীকার,
সব বিভ্রান্তির অবসান হয় যখন ১১ই জানুয়ারি ৭০ সালে আওয়ামী লীগের পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে মঞ্চ থেকে জনাব সিরাজুল আলম খান ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পল্টন ময়দানের জনগণকে মুখরিত করে তুলেন। ঐ মঞ্চের মাথার উপর টানানো ছিল শক্ত হার্ডবোর্ডে লাল অ¶রে লেখা ‘জয়বাংলা’। এই ‘জয়বাংলা’ লেখা হার্ডবোর্ডটা বুয়েট থেকে আমি এবং আমার সহযোদ্ধা শরীফ নুরুল আম্বিয়া, খায়রুজ্জামান, ইউসুফ সালাউদ্দিন, এনামুল হক, সানি, নজরুল, আজাদ, রফিকসহ আরে অনেকে তৈরি করে টানিয়ে দিয়েছিলাম দুপুর ১২টার সময়। এবং বঙ্গবন্ধু আসা পর্যন্ত এই মঞ্চ ঘিরে আমরা পাহাড়ায় বসেছিলাম। ‘জয়বাংলা’ ধ্বনির প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ সমর্থন আছে তা দেখানোর জন্যে। আগেই বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন, প্রশ্রয়ে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এবার পল্টনের জনসভায় তার মঞ্চে ‘জয়বাংলা’ লেখা বোর্ড ও ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান কার্যত বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অনুমোদন লাভ করে। সেদিন থেকে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি জাতীয় ধ্বনিতে পরিণত হয়।
মাননীয় স্পীকার,
এই ধারাবাহিকতায় ৭০ সালে ৭ই জুন ছয়দফা দিবসে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিকে সামনে নিয়ে ‘জয়বাংলা বাহিনী’ গঠন হয় এবং সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ হয় পল্টন ময়দানে সকাল দশটার দিকে।
মাননীয় স্পীকার,
এই ‘জয়বাংলা বাহিনী’র নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম রব, কামরুল আলম খান খসরু ও আমি। এখানেই ‘জয়বাংলা বাহিনী’র রেজিমেন্ট্যাল ফ্ল্যাগ বাংলাদেশের মানচিত্রসহ লাল সবুজ পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেয়া হয়। এই পতাকাই পরে ২রা মার্চ ৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শন করা হয়, যা জাতীয় পতাকা হয়।
প্রকাশ হচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের জন্যে, বঙ্গবন্ধুর অপূর্ব রাজনৈতিক বহুমাত্রিক কৌশলের প্রকাশ হচ্ছে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান, ‘জয়বাংলা বাহিনী’র সামরিক কুচকাওয়াজ। আমি বিস্তারিত যাচ্ছি না, পরবর্তীতে ৭১ সালে আবার ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস নাকচ করে দিয়ে ‘জয়বাংলা বাহিনী’ ঢাকার পল্টনে, সারদেশে জেলা মহকুমা শহরে সামরিক কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। আমার উপরে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পরে পল্টনে পতাকা উত্তোলনের। তাজা পিস্তল ফুটিয়ে আমি পতাকা উত্তোলন করি। আর কামরুল আলম খান খসরু গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে সালাম দেয় এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের চার নেতা নুরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, রব এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন সালাম গ্রহণ করেন। পল্টন ময়দানের আনুষ্ঠানিকতা সেড়ে প্যারেড করতে করতে ৩২ নম্বরে যান এবং বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকা তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু সেই ‘জয়বাংলা বাহিনী’র সালাম গ্রহণ করে একটা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।
আমি মাননীয় স্পীকার তা বলতে চাচ্ছি। উনি বলেন, ‘জয়বাংলা বাহিনীর ভাইয়েরা, আপনার সকাল থেকে এখন অবধি কুচকাওয়াজ করছেন। আপনারা আরো ট্রেনিং নেন আরো প্রস্তুত হয়ে যান। আমি আপনাদের কাছে মাত্র একটি কথা বলবো সাত কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। আপনাদের মনে রাখা দরকার নীতির সঙ্গে কোনো আপোষ হয় না। যদিও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে চাই। কিন্তু নীতির সঙ্গে আপোষ হয় না। এদেশের মানুষকে কলোনিয়াল ভাবতে দেয়া হবে না। (এখানে সময় শেষ হওয়ার কারণে মাইক বন্ধ হয়ে যায়। এরপর স্পীকার ১ মিনিট সময় বাড়িয়ে দেন)।
‘জয়বাংলা’ শ্লোগান এরপরে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পরে যুদ্ধের রণধ্বনিতে পরিণত হয়। ‘জয়বাংলা বাহিনী’ রূপান্তরিত হয় মুক্তিবাহিনীতে এবং পাকিস্তানিদের পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। আজকে যখন ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানকে রাষ্ট্রীয় শ্লোগান হিসাবে ঘোষণা করা হল, তখন এদেশের মাটিতে কিছু মোনাফেক, পাকিস্তানপন্থার সা¤প্রদায়িক চক্র রাষ্ট্রকে অস্বীকার করে চলেছে। বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, জয়বাংলা, বাংলাদেশের সংবিধান অস্বীকারকারী রাষ্ট্রের এই চিহ্নিত চিরশত্রু পাকিস্তানপন্থী, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, রাজাকারচক্রকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে ‘জয়বাংলা’ রণধ্বনি কন্ঠে ধারণ করে উন্নত, সচ্ছল, আধুনিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরেপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। জয়বাংলা।