আবু বাসার আখন্দ: সমালোচনা কি অপরাধ? সংবাদ প্রকাশ বা মতামত দেওয়ার কারণে একজন সাংবাদিককে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলার মুখোমুখি করা কি সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন নয়?—যখন এই প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে সাংবাদিক আনিস আলিমগীরের বিরুদ্ধে দায়ের করা সন্ত্রাস বিরোধী মামলাকে কেন্দ্র করে। ঠিক এই সময়েই দেশের প্রধান দুটি গণমাধ্যম কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। একই রাতে লাঞ্ছিত হন প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সম্পাদক নূরুল কবির।
ঘটনাগুলোর সময়কাল ও ধারাবাহিকতা প্রশ্ন জাগায়—এগুলো কি নিছক বিচ্ছিন্ন সহিংসতা, নাকি সাংবাদিক সমাজের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত বার্তা?—সে প্রশ্নও এখন আলোচনার কেন্দ্রে।
সমালোচনা কি অপরাধ—এই প্রশ্নটি এখন আর কেবল মতাদর্শিক বিতর্ক নয়, বরং বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বাস্তব সংকট।
এই ভয় রাজধানী ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে জেলা শহর ও মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে।
মাঠপর্যায়ে কাজ করা অনেক সাংবাদিক এখন দ্বিধায়—কোন খবরটি করা যাবে, কোনটি করা যাবে না। সরকার বা ক্ষমতাসীন মহল অসন্তুষ্ট হতে পারে—এমন আশঙ্কায় সংবাদ এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হলে তা শুধু সাংবাদিকতার জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জানার অধিকারের জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে।
আইন ও সংবিধানের দৃষ্টিতে এই উদ্বেগ অমূলক নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ নাগরিকদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। এই স্বাধীনতা রাষ্ট্র, সরকার, ক্ষমতার প্রয়োগ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকারকেও অন্তর্ভুক্ত করে। গণতন্ত্রের ভিত্তিই হলো এই প্রশ্ন করার অধিকার।
তবে একই অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যুক্তিসংগত সীমাবদ্ধতার কথাও বলা হয়েছে। আইনজ্ঞদের মতে, এই সীমাবদ্ধতা কখনোই এমনভাবে প্রয়োগ করা যায় না, যাতে মৌলিক অধিকার কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। সমালোচনামূলক সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রবিরোধী বা নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখানো হলে সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সরাসরি সংঘাত তৈরি হয়।
এই প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের প্রয়োগ বিশেষভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। মানবাধিকার বিশ্লেষকদের মতে, এই আইন সহিংস সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সশস্ত্র উসকানি দমনের জন্য প্রণীত। তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক সমালোচনা বা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এই আইনের আওতায় পড়ার কথা নয়। যদি কোনো সাংবাদিক সরাসরি সহিংসতায় উসকানি না দেন, বরং রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে যুক্তিনির্ভর প্রশ্ন তোলেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করা সাংবিধানিক ও আইনগত—উভয় দিক থেকেই দুর্বল।
সংবাদ প্রকাশের কারণে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা মানে কেবল একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ নয়; এটি পুরো সাংবাদিক সমাজকে একটি নীরব বার্তা দেয়—সমালোচনার মূল্য চুকাতে হতে পারে। যখন একদিকে গণমাধ্যমে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দৃশ্যমান প্রতিরোধ নেই, আর অন্যদিকে সমালোচকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ হয়, তখন রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। গণমাধ্যমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব, অথচ সেই দায়িত্ব পালনে ঘাটতি স্পষ্ট।
দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ অবস্থাকে উদ্বেগজনক বলেই দেখছে। তাদের মতে, সমালোচনা অপরাধ নয়; বরং স্বাধীন সাংবাদিকতা রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার অন্যতম শর্ত। মতপ্রকাশ দমন করতে আইন প্রয়োগ করলে তা সংবিধানের মৌলিক চেতনার পরিপন্থি হয়ে ওঠে এবং দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের ওপরই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও একই শিক্ষা দেয়। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেখানে সাংবাদিকের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত, মতপ্রকাশকে অপরাধ বানানো হয় না এবং গণমাধ্যমে হামলাকে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হিসেবেই দেখা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও স্পষ্টভাবে বলে—রাষ্ট্রের কাজ সাংবাদিককে সুরক্ষা দেওয়া, নীরব করতে আইন ব্যবহার করা নয়।
এই প্রেক্ষাপটে সামনে তাকালে একটি প্রশ্নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে—ভবিষ্যৎ করণীয় কী? বিশ্লেষকদের মতে, প্রথমত, সন্ত্রাস বিরোধী আইনসহ কঠোর আইনগুলোর প্রয়োগে স্পষ্ট নীতিমালা ও বিচারিক নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এসব আইন ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার না হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমে হামলা, ভাঙচুর ও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভাঙে। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রকে স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা দিতে হবে—সমালোচনামূলক সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের শত্রু নয়, বরং গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ।
শেষ পর্যন্ত সত্যটা খুব সরল—সমালোচনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নয়। বরং সমালোচনাই রাষ্ট্রকে নিজের ভুল চিনতে ও সংশোধনের সুযোগ দেয়। এই সমালোচনাকে অপরাধে পরিণত করার প্রবণতা চলতে থাকলে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের ভবিষ্যৎই অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাবে। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হলে আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—ভয়ের পথে, না কি স্বাধীন মতপ্রকাশের পথে।
আবু বাসার আখন্দ, গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিক, দৈনিক যুগান্তর।