অনন্যা হক : বাসাটা ফাঁকা, একটা শুনশান নিরবতা চারিদিকে। সব কাজ শেষ করে নিজের ঘরে এসে বসলাম। জানালার কাছে বসে পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। হাতে একটা গল্পের বই নিলাম পড়বো বলে।
এখন দুপুর। আজ রোদের প্রখরতা কম। আকাশে হালকা মেঘ, মেঘগুলো ভেসে ভেসে সরে যাচ্ছে। জানালার গ্লাসটা সরিয়ে দিয়ে ইচ্ছে করলো দুপুরের সূর্য হেলে পড়া হালকা মেঘ পুঞ্জ আবরিত আকাশটা দেখতে।
একটা মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে, মুখে এসে লাগছে।একটা ছাইরঙা পরিবেশ চারিদিকে।নারিকেল গাছ, নিম গাছের ডালপালাগুলো বাতাসে হালকা দুলছে। খুব ভাল লাগছে বাইরেটা দেখতে। নারিকেল গাছের ডালে দুটো পাখি একে অপরের গা ঘেঁষে বসে আছে নিশ্চুপ।
একজন আর একজনের গলার কাছটাতে খুঁটছে।যেন প্রেয়সীর সাথে এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তের নীরব উদযাপন। আর কি যেন এক পরম সুখে সোহাগী পাখিটা মাথা নুয়ে বসে আছে ঝিম মেরে। তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি তাদের এই শরীরী ভাষা। কিছুটা আনমনা হয়ে যাই। চলে যাই যেন অনেকটা সময় পেছনে সেই সুদূর অতীতে। যখন দুপুরটা ছিল কম বেশী সকলের জন্যে একটা আয়েশী সময়।
দুপুরটা সারাজীবনের সকল সময়ের একটা অতি প্রিয় সময়।একটু নিভৃতে, নিজের জগতে,নিজের সাথে সময় কাটাতে যারা ভালবাসে তারা এই সময়টাকে একটু অন্য রকম করে উপভোগ করতে পছন্দ করে। মাঝ দুপুরের সূর্যের প্রখরতা কমে এসে পড়ন্ত বিকেলের আগ পর্যন্ত এই সময়টা অলস দুপুর বলেই যেন নামকরণ হয়ে যায় এক সময়। আজ সে সব দিন শুধুই অতীত।তাই এই শব্দটাও যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। তবুও যারা ঘরে থাকে তারা যদি দুপুরটা নিজের মতো কাটাতে চায় হয়তো তেমন করেই সময় বের করে নিতে পারে। আর। যারা পুরোটা দিন কর্মস্থলে থাকে তারাও হয়তো কাজের অবসরে এই সময়টাতে একটু ক্লান্ত হয়, কিংবা কিছুটা আনমনা হয়।
আগে বেশীর ভাগ মানুষ বেড়ে উঠেছে একান্নবর্তী পরিবারে। তখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি, কাজের ধরনের সাথে সব কিছুর এখন ভিন্ন ধারা।তাই সময়ের রকমফেরের সাথে মনের চাহিদার বৈচিত্র এখন শুধুই বিলাসিতা। তবুও হয়তো ছুটির দিন গুলোতে মনবিলাসী মানুষ গুলো এসবের কিছুটা মর্ম উপলব্ধি করতে পারে।
একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠার সময় দেখেছি, এই সময় টা ছোট বড় সকলের জন্য বিশেষ একটা সময় ছিল। সংসারের বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়ে যেত এ সময়ে ।যে যেমন পছন্দ করে, সে তেমন করেই সময়টা উপভোগ করতো। যারা ঘুম কাতুরে, তারা ঘুমকে বেছে নিতো।যারা পড়ুয়া, তারা বই খাতা নিয়ে বসতো।
কেউবা গল্পের বই, রেডিওতে গান, নাটক শোনা, কেউ বসে শেলাই করা, উল বোনা, এমনই বয়স ভেদে বাহারি কাজের, মনোজগতের ইচ্ছেবিলাসী কাজের সময় ছিল যেন দুপুর সময়টা। যারা গল্প করতে ভালবাসে তারা পাড়া বেড়াতে বের হোত। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে মানুষ অবসরে একত্রিত হয়ে নিজেদের কথার, ভাবের আদান প্রদান আজ যেন স্বপ্নের মতোই এসব। তাই তখনকার আন্তরিকতাও ছিল মন ছোঁয়া।
কেউবা ম্যাটানি শোতে সিনেমা দেখতে যেত, আবার বাউন্ডেলেপনার জন্যও সুবিধা জনক সময় এটা। মফস্বল শহরে অল্পবয়সী ছেলেরা বের হয়ে যেত হয়তো অভিভাবকদেরকে লুকিয়ে তাদের ইচ্ছেস্বাধীন কর্মকান্ড করতে। অথবা ক্লাব গুলোতে জড় হয়ে আড্ডার পাশাপাশি চলতো বিভিন্ন ইনডোর্স গেম নিয়ে মাতামাতি।
দাদি, নানি, মা চাচীদেরকে দেখা যেত এসময়ে বসে মুড়ি, চিড়া, খই ভাজতে, কিংবা খেজুরের গুড়ের পাটালি বানাতে। কখনও কাঁথা সেলাই বা বিভিন্ন কাপড়ে রঙিন সুতোর এমব্রয়ডারির কাজ করতে। কিছুটা কাজ আর কিছুটা অলসতার সমন্বয়ে সময়টা কাটতো সবার।
সংসারের সব দৈনন্দিন কাজ শেষ হলেও যেন শেষ হয়েও হইলো না শেষের মতো আবার তারা কাজ খুঁজে বের করতেন। যারা ঘুম কাতুরে নয়, তারা একটা কাজ ঠিক বেছে নিতেন।
সব যেন মন বাহারি কাজ! এই সময়ের অলস দুপুরে এসে এমন অনেক কিছুই মনের জানালাতে ভেসে ওঠে। স্মৃতির অতল থেকে ভেসে আসে হারিয়ে যাওয়া সময়।হারিয়ে যাওয়া প্রিয় সব সময়ের গহ্বরে ভেসে যাওয়া মনপছন্দের কাজ গুলো। ছোট বেলায় এসময় লুকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে, পুকুরের ধার ঘেঁষে বেলে মাটিতে শুয়ে থাকা ছোট মাছ ধরেছি। পুকুরের ধার ঘেঁষে সারি দিয়ে ভাইবোন বন্ধুরা মিলে বরশিতে মাছ ধরার সে কি অনাবিল আনন্দ!
টিনের চালে উঠে বসে থেকেছি, মনে হতো যেন আকাশের কিছুটা কাছে যেতে পেরেছি। কত ছোট ছোট সহজ ভালোবাসা, ভালো লাগার সেই জীবন! গাছের ডালে বসে থেকেছি কত। গাছের ডালে পাখিদের বসে থাকার ভেতরে কেমন একটা ভীষণ স্বাধীনতার স্বাদ বোঝা যায়। আকাশের কাছে সবুজের মাঝে, পাখিদের মতো গাছের মগডালে দোল খেতে না পারলেও গাছে বসে থাকার মজাও অশেষ। এই সব কিছুর জন্যেই অলস দুপুর ছিল উপযুক্ত সময়।
আজ মনে পড়ছে এই অলস দুপুরে, হারিয়ে যাওয়া সেই সব স্মৃতিমধুর দিনের কথা। মনে পড়ছে কৈশোরে বন্ধুর সাথে সময় কাটাতে সবুজ ঘাসের মাঝে চিকন এক ফালি সাদা মাটির পথ দিয়ে এক পায়ে লাফিয়ে হেলে দুলে চলার কথা! বাসার পেছনের জানালায় টোকা দিয়ে বন্ধুকে নাম ধরে ডেকে বের করে তার সাথে নিজেদের দুরন্তপনার যত গল্প।
এই দুপুরটা যৌবনেও ছিল সমান প্রিয়, যখন বাড়ি থেকে বের হতে ছিল পায়ে পায়ে বিধিনিষেধের বেড়াজাল। তখন বাড়িতেই থিতু হয়ে বসে থাকতে হতো। তখন এ সময়টাতে গল্পের বই পড়া, রেডিওতে গান, নাটক শোনা ছিল এক দারুণ নেশা। কড়াকড়ির ভেতরেও চোখের ফাঁক গলে প্রিয় বন্ধবীর সান্নিধ্যে গিয়ে নিজেদের অন্তরঙ্গ আলাপনের অজস্র সুখ স্মৃতি আজ এই দুপুরে মনকে চঞ্চল করে।
একবারে বর্ণনার অতীত সুন্দর, প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বাসে ভরা একটা সময় কাটিয়েছি তখন। মানুষের মন হাজার ব্যস্ততার মাঝেও একটু প্রাণের খোঁজে ব্যাকুল থাকে। স্মৃতির ভেতরেই জীবনকে বারবার খুঁজে আনতে অতীতে ফিরে ফিরে তাকায়। অলস দুপুর স্মৃতিচারণেরও এক নীরব সময়। এতক্ষণ অতীতের অলস দুপুরে হারিয়েছিলাম। হাতের বইটা কখন রেখে দিয়েছি বিছানায় ভুলে গিয়েছি। এক পাতাও পড়িনি।
আকাশের দিকে আবার চোখ গেল। হঠাত্ করে মেঘটা বেশ কালো হয়ে ঘনিয়ে এল যেন। গুড়গুড় শব্দ করে ডেকে উঠলো, ফিরে এলাম বর্তমানে। সম্বিত ফিরে এল।দেখলাম পাখি দুটো ওখানে আর নেই। হয়তো বৃষ্টির ভয়ে ভেতরে কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। নাকি উড়ে চলে গিয়েছে অন্য কোন আশ্রয়ের খোঁজে।
আজ একটা মেঘলা দিনের অলস দুপুর মনের মগ্নতায় কেটে গেল। এখনও এই জীবনে আবার সেই অলস দুপুর প্রতিদিন একটা করে আসে যায়। ঘুম আসতে চায় না এখন আর। চঞ্চল মনটা শুধু কি যেন খুঁজতে থাকে, যার সবই বায়বীয়। দেখা যায় না, ধরা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।নিজের ভেতরে নিজেকে খুঁজি বারবার। মাঝে মাঝে খুঁজে পাই। হারানো আপন মানুষদেরকে খুঁজি। স্নেহ মায়া মমতা ভালোবাসা প্রেম সব কিছুর অনুভব মনের গহীনে এসে ভর করে।
হঠাত্ ইচ্ছে করে গান শুনতে। মোবাইলে গানটা চালিয়ে দিলাম। বহু দিনের ওপার হতে আষাঢ় এল, এল আমার মনে, কোন সে গানের ছন্দ বাজে, ঝরঝর বরিষণে।
খুব প্রিয় সময়টা এমন একাকী সময়ের মাঝে ডুবে কাটাতে যেন এ এক অন্য রকম ভাল লাগা।তবুও একটা আক্ষেপ উঁকি দেয় মনে মাঝে মাঝে।সেই প্রাণের খোঁজে অনেক প্রিয় মুখ গুলোর সান্নিধ্যের বড়ই অভাব অনুভব করি। আড্ডা,হাসির বড়ই অভাব বোধ করি।
অলস দুপুর একেবারে আগের মত হবে না কখনও। কিছুই আগের মত হয় না। শুধু নতুন আঙ্গিকে সেজে সেজে আসতে থাকে জীবনে। এভাবেই সময় পাল্টে যায়, জীবন পাল্টে যায়, কিন্তু অনুভব রয়ে যায় স্মৃতির পাতায় আটকে।
অনন্যা হক: লেখিকা, কবি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী