আজ, শুক্রবার | ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | রাত ৮:৪৯

ব্রেকিং নিউজ :
মাগুরা জেলা বিএনপির নতুন কমিটিকে ছাত্রদলের অভিনন্দন মাগুরা জেলা বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা মাগুরার রওশন ট্রাস্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার পদে নিয়োগ দিচ্ছে মাগুরায় বিএনপি সহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে মুক্ত দিবস পালন মাগুরার দারিয়াপুর কলেজ পরিচালনা কমিটি গঠন নিয়ে বিএনপির দু’ গ্রুপে ব্যাপক সংঘর্ষ গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের অব্যাহতিতে মহম্মদপুরে আনন্দ মিছিল মাগুরার আঠারোখাদা গ্রামে ছেলের ছুরির আঘাতে বৃদ্ধ বাবা খুন মাগুরায় বাংলাদেশের আলো পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা বার্ষিকী উদযাপন মাগুরা জেলা যুবদল সভাপতি সম্পাদককে বহিস্কারের দাবি মাগুরায় ছাই কারখানা অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন

আমার নিভৃতচারী মা 

মাজহারুল হক লিপু : বৌমা ঘুম ভাঙলো? – ফজরের নামাজ পড়ে, চুলায় চায়ের পানি চড়িয়ে দিয়ে,রান্না ঘরের জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে এরকম ডাক দেওয়া ছিল আমার মায়ের দিনের প্রথম কাজ। আমাদের বাড়ির চারপাশে মুসলিম পরিবারের চেয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিবারই বেশি। কিন্তু, কে কোন ধর্মের তা ভাবার চেয়ে সবার আগে তাদেরকে প্রতিবেশী হিসেবেই  বেশি ভাবতেন মা।

আমাদের বাড়িতে কেউ এলেই বিস্মিত হতেন মায়ের কথা বলার ভঙ্গিতে।
অনেকেই বলতেন, তোমার মা শান্তি নিকেতনী ভাষায় কথা বলেন।
আমি বলতাম, ‘ তাতো বলবেনই। মা যে বীরভূমেরই মেয়ে।’এটুকু শুনে নানা প্রশ্ন করতেন সবাই। দেশ বিভাগের আগেই কোলকাতা থেকে আমার নানা মহকুমা শিক্ষা অফিসার হিসেবে বদলী হয়ে আসেন মাগুরায়। তারপর থেকে মা মাগুরার বউ।

যে কথা বলছিলাম।  মায়ের ভাষা শুনে আকৃষ্ট হত যে কেউ। আমার বাবা একজন প্রবীণ আবৃত্তিশিল্পী হলেও আমার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চর্চাটা তৈরি হয়েছে মায়ের কাছেই।  শিল্প সংস্কৃতির প্রতি মায়ের ছিলো প্রবল আগ্রহ। ছেলে মেয়েদের সংস্কৃতি চর্চার জন্য মায়ের ভূমিকা ছিলো নেপথ্যের অথচ গুরুত্বপূর্ণ।  আজকাল মায়েদেরকে যেমন দেখা যায় বাচ্চাকে নিয়ে গান, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন শিক্ষকের কাছে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আমার মাকে তা দেখিনি। আমার মাকে দেখেছি বাড়িতে গানের শিক্ষক রাখতে। অনুষ্ঠান থাকলে আমাদের কি পোশাক লাগবে তা প্রস্তুত করে দিতে। আমরা যখন সাংগঠনিক চর্চায় যুক্ত হয়েছি, ঢাকা থেকে বিভিন্ন শিল্পী আসতে শুরু করলেন আমাদের বাড়িতে। মা পরম যত্নে রান্না করেছেন অতিথিদের জন্য। গোলাম সারওয়ার, মীর বরকত, আহকাম উল্লাহ, মাহিদুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, রবিশঙ্কর মৈত্রী, মাসকুর-এ- সাত্তার কল্লোলসহ অসংখ্য আবৃত্তিশিল্পী মাগুরায় এলে মা নিজ হাতে রান্না করে একবেলা হলেও খাইয়েছেন। পরবর্তীতে ঢাকা বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেসব রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আবৃত্তি শিল্পী এসেছেন মা বৃদ্ধ বয়সেও তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেছেন। শুধু তাই নয়, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা এলেই মা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তারা কী খেতে পছন্দ করে জানার জন্য।  আমার বড় ভাইদের বন্ধুদেরাও ছিলো মায়ের খুব স্নেহের। এতো গেলো আমাদের প্রজন্মের অতিথিদের কথা। বাবার অতিথি হিসেবে দেশের বিশিষ্ট মানুষেরা আমাদের বাড়িতে এসেছেন এবং মায়ের আতিথ্যে মুগ্ধ হয়েছেন।  আমার খুব মনে আছে, আব্বার নিমন্ত্রণে  আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আমাদের বাড়িতে এসে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে খুব প্রশংসা করলেন।  মাকে ডেকে এনে অনেক গল্প করলেন। একসময় আব্বাকে তিনি বললেন, গুনী স্ত্রী আপনার।

আমার বাবা বরাবরই কর্ম পাগল এক মানুষ। শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন।  কখনও সারাদিন পর রাতে ফিরেছেন বাবা। বাবার অনুপস্থিতি  বুঝতে দেননি মা। আমাদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে বাজার, রান্না সব সামলিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে টাউন হল ক্লাবে যখন নাটকের কাজ শুরু হতো দিন রাত বাবাকে বাড়িতে পেতাম না আমরা। অথচ মা একটুও বিরক্ত হতেন না। সবকিছু সামলে নিয়ে নাটকের দিন আমাদেরকে নিয়ে চলে গেছেন হলে।  নাটক সফল হলে বাবার চেয়ে মায়ের মুখেই যেন বেশি দেখতাম পরিতৃপ্তির হাসি।

মায়ের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা পেয়েছি কিভাবে অসাম্প্রদায়িক মানুষ হতে হয়। আমার মায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন ছিলো না। কিন্তু জ্ঞান ছিলো সমৃদ্ধ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কখনো বাদ পড়তে দেখিনি। ব্যবহার, চলাফেরা সবকিছুর মধ্যেই ছিলো রুচিশীলতা।  সবকিছুর উপরে মা স্থান দিতেন মানুষকে।

আগেই বলেছি, আমাদের বাড়ির চারপাশে হিন্দু পরিবারই বেশি। মায়ের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিলো ঘনিষ্ঠ। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি পাশের হিন্দু পরিবারগুলোর সব বিয়ের অনুষ্ঠান আমাদের বাড়িতে আয়োজন করা হয়। এ আয়োজনে মায়ের বড় একটা ভুমিকা ছিলো। এসব নিয়ে অনেকে মাকে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু, মায়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনা সেসব কোন কিছুকেই পাত্তা দেয়নি কোন কালে। অথচ মায়ের ধর্ম চর্চায় কোন কমতি আমরা দেখিনি।

বাবার চেয়ে মায়ের শারীরিক অবস্থা কখনোই ভালো ছিলো না। কিন্তু কখনো মা তার দূর্বলতাকে বুঝতে দেননি আমাদের কাছে।  মৃত্যুর সাতদিন আগেও গিয়েছেন রান্না ঘরে। নিজ হাতে তদারকি করেছেন সবকিছু।  মায়ের বয়স হয়েছিলো চুরাশি বছর।  তারপরও মায়ের মানসিক শক্তির কারণে আমরা কখনো ভাবিনি মা চলে যেতে পারেন। ছোট খাটো অসুস্থতা মা কখনো বুঝতে দেননি কাউকে । যেদিন ফকির আলমগীর মারা গেলেন, আমরা তিন ভাই ফেসবুকে একটা লাইভ প্রোগ্রাম করেছিলাম। মা খুব ফকির আলমগীর ভক্ত ছিলেন।  মায়ের একধার দুধের দাম গানটা খুব পছন্দ করতেন।  লাবনীর কাছে ফকির আলমগীর চলে যাওয়া নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।  আমরা তিন ভাই একসাথে গান করেছি বলে খুব খুশিও হয়েছিলেন।  তার দুদিন পর থেকেই মা অসুস্থ। প্রচণ্ড জ্বর। হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।  মা অনেকটা ভালো হয়ে উঠলেন।  মায়ের ব্যবহার দেখে একজন চিকিৎসক বললেন, আপনার মা এত সুন্দর করে কথা বলেন? হঠাৎ মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলো। সময় দিলেন না আমাদেরকে। হয়তো মা এমনটিই চাইতেন।

আমার নিভৃতচারী মা।
কখনো মুখাপেক্ষী হতে চাইতেন না কারো।
হয়তো তাই এরকম নিরবে চলে গেলেন।
যেখানেই থাকো তোমার মত থেকো, আমার নিভৃতচারী মা।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology