অনন্যা হক :: ‘ইট্টুস খানি দেখ, একখান কথা রাখ’- কাজী জহির পরিচালিত ‘বধু বিদায়’ সিনেমার এই গানটা সেই ছোটবেলায় মনে ভীষণ দাগ কেটেছিল। যেন এক নিঃশ্বাসে দেখা একটা সিনেমা, সে বয়সের আবেগ বলে কথা! ত্রিভুজ সম্পর্কের একটা সিনেমা ছিল ‘বধু বিদায়’, শেষদৃশ্যে কবরী নিখুঁত অভিনয় দিয়েতাঁর আত্মত্যাগকে ফুটিয়ে তোলেন। এই সিনেমাটা দেখার পর নায়িকা কবরী সত্যিই একটু ভিন্ন ভাবে মনে গেঁথে যায়। তাঁর মৃত্যুর সেটা যেনো আবার টের পেলাম।
কবরী দেখতে যেমন মিষ্টি তেমন মিষ্টি তার কন্ঠ। অভিনয় অত্যন্ত সাবলীল,কোন অতি অভিনয় ছিল না, এ কারণেই তাকে আমার বিশেষ ভাবে, একটু আলাদা করে ভালো লাগতো সব সময় অন্য অনেকের তুলনায়। তাঁকে বরাবরই মনে হয়েছে সম্পূর্ণা একজন।
চিটাগং এর মেয়ে তিনি। মিনা পাল থেকে পরে কবরী নামে আবির্ভাব হলেন চলচ্চি্ত্রে। জন্ম ১৯ জুলাই ১৯৫০ সাল। পুরা নাম সারাহ বেগম কবরী। তিনি একাধারে একজন অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং জীবনের শেষ ভাগে এসে একজন রাজনীতিবিদের খাতায়ও নাম লেখান। তবে তার সব থেকে বড় পরিচয় তিনি সেই জনপ্রিয় অভিনেত্রী যিনি ষাট এবং সত্তর দশকে বাংলাদেশ সিনেমা অঙ্গনের পর্দা কাঁপানো বা বলা যায় মনে দাগ কেটে রেখে যাওয়া অভিনেত্রী।
১৯৬৪ সালে গুণী পরিচালক সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে পা রাখেন কবরী। এরপর একের পর এক ছবিতে অভিনয় করে দর্শক হৃদয় জয় করে হয়ে ওঠেন এক নামে পরিচিত মিষ্টি মেয়ে কবরী। নামকরা, ব্যবসাসফল বহু পরিচ্ছন্ন সিনেমায় অভিনয় করে তিনি এক অনন্য অবদান রাখেন চলচ্চিত্রে। তার ছিল ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা! তার নায়ক ছিলেন অনেকেই। রাজ্জাক, ফারুক, বুলবুল আহমেদ, সোহেল রানা, উজ্জ্বল এমন অনেকের সাথে অভিনয় করেছেন তিনি। তবে বিশেষ জুটি হিসেবে রাজ্জাক কবরী দীর্ঘদিন দর্শক হৃদয় জয় করে রাখেন।
তার বহু সিনেমার মধ্যে নামকরা,তখন থেকে এখন পর্যন্ত মনে রাখার মতো হলো-সারেং বউ, সুজন সখী, বধু বিদায়, নীল আকাশের নীচে,দর্পচূর্ণ, স্মৃতিটুকু থাক, দীপ নেভে নাই, রংবাজ, তিতাস একটি নদীর নাম, দুই জীবন- ইত্যাদি আরো অনেক আছে। সুজন সখী ছিল খুব সহজ সরল আবেগের মিষ্টি প্রেমের সিনেমা।সব সখীরে পার করিতে নেবো আনা আনা গানটাতেও তার মধুর আবেগী প্রকাশ অত্যন্ত মন কাড়া ছিল।
‘বধু বিদায়’ ছিল তার এক অভিমানী নায়িকার সুন্দর চিত্রায়নের ছবি। আগেই বলেছি এটাও মনে দাগ কেটেছিল খুব। বিশেষ করে তার লিপসিং এ গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ইট্টুস খানি দেখ গানটার অত্যন্ত মিষ্টি প্রাণবন্ত উপস্থাপন খুবই দৃষ্টি কাড়া দৃশ্য, মনে পড়ে সব সময়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বউ’ তাঁর এক অত্যন্ত সাড়া জাগানো বিখ্যাত ছবি।যা সিনেমা হলের দর্শকদেরকে কাঁদিয়ে ছেড়েছিলো। পুরো সিনেমাটায় দুঃখ আর বিরহের ভেতরে অতিবাহিত করে অবশেষে যার পরিসমাপ্তিও হয়েছিল অনেক দুঃখের পর মিলনের আবহে।
এটাতে তার একটা সংলাপ ছিল নায়ক ফারুককে উদ্দেশ্য করে বলা-সারেং এর ব্যাটা কি বেহায়া গো! যা এত সুন্দর করে প্রক্ষেপণ করেছিল যে,এখনো আমাদের কানে বাজে কথাটা। তাঁর হাসি, কন্ঠ, কথা বলার ঢং, চাহনি, চলার ভঙ্গিমা সবই দৃষ্টিনন্দন ছিল।
আমাদের মাগুরা শহরে মধুমতী সিনেমা হলে এই ছবিগুলো দেখেছি এক সময়।মনে দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল মনে পড়ে।তখন থেকেই কবরী আমার প্রিয় নায়িকার তালিকায় স্থান পায়।
তিনি একদিকে লাস্যময়ী অন্যদিকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চরিত্রের সমন্বয়ে এক অনবদ্য চরিত্রায়নের রুপকার ছিলেন। কবরী জীবনকে ভিন্ন আঙ্গিকে চলচ্চিত্রে সফল ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন সব সময়।
কবরী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন একাধিকবার। মেরিল পুরস্কার,ঋষিজ পদকসহ পেয়েছেন দেশ বিদেশের অনেক পুরস্কার। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মাননা।
অবশেষে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় তিনি এই মহামারী কালে করোনার বিষাক্ত ছোবলে ২০২১ সালের ১৭ই এপ্রিল তিনি এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
‘স্মৃতিটুকু থাক’ শিরোনামে তিনি এক সময় তাঁর আত্মজীবনীতে তার চলচ্চিত্র জীবনের বিভিন্ন বাঁকে ঘটে যাওয়া অনেক বিষয় লিপিবদ্ধ করে গেছেন।এই নায়িকা আমাদের মনের আখরে গেঁথে থাকবেন আজীবন। তাঁর স্নিগ্ধ-সুন্দর কাজের মাধ্যমেই তিনি বেঁচে থাকবেন দর্শক হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে, চিরজীবন!
অনন্যা হক: লেখিকা, কবি