সুলতানা কাকলি : কতো শহর! দর্শনীয় স্থানে গেলাম দেখলাম! মনকে সমৃদ্ধ করলাম। নিজের জেলা, প্রাণের জেলাসহ পাশের জেলাগুলোতে কত দর্শনীয় স্থান আছে তার কতটুকুইবা দেখেছি? এটা ভাবিনিতো কখনও! নতুন করে এই চিন্তা মাথায় সেট হয়ে বসেছে।
এখন ভাবছি, নিজের জেলা সহ পাশের জেলাগুলোর সব দর্শনীয় স্থানগুলো আগে দেখবো। আর তারই আলোকে হঠাৎ করে বান্ধবী মুক্তির আহবানে, ওর বড় ভাই লেনিন ভাইয়ের সৌজন্যে বন্ধু ঝন্টু, মুক্তি এবং আমার জীবনসঙ্গীসহ পাঁচ জনের একটা ছোট্ট দল নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বলাডাঙ্গা, নড়াইলের ইছামতি বিল দেখতে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে, মাগুরা জেলার অন্তর্গত মহম্মদপুর উপজেলায় নহাটাতে গেলেও এ বিলটিকে আপনারা দেখতে পাবেন। আমরা মাগুরার সীমান্ত এলাকা হতে এই বিলটি দেখতে চেয়েছি বলেই নড়াইলের বলাডাঙ্গা গ্রামে যেয়ে ইছামতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছি।
মেঘলা আকাশ, মিষ্টি বাতাস, মনোরম পরিবেশের মধ্যদিয়ে মাগুরা হতে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। বন্ধু ঝন্টু গাইডের পথ নির্দেশনায় আমরা গ্রামের মসৃণ আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটে চললাম। ধলহারার মধ্য দিয়ে ছায়াঢাকা, কোলাহল বিহিন পথ ধরে শত্রুজিৎপুর বাজারে পৌঁছানোর আগেই লেনিন ভাই ডাব বিক্রেতাকে দেখে খুশিতে গাড়ি থামিয়ে ফেললেন। সদ্য গাছ হতে ডাব পেড়ে বাজারে নিয়ে যাচ্ছে বিক্রি করতে। একদম টাটকা ডাব! এর লোভ সংবরণ করা কঠিন আমাদের পক্ষে। ডাব কেনা হলো ঠিকই কিন্তু খাওয়া হলো না। কারণ ইছামতি বিলে রোদ্দুরে নৌকায় ঘোরাঘুরি করার পরে এই টাটকা ডাব শরীরে সতেজ অনুভুতি এনে দেবে। অবশ্য আমাদের লেনিন ভাইকে সতেজ রাখার জন্য সবার সম্মতিতে উনি আয়েশ করে একটা ডাব ওখানেই খেয়ে পরিতৃপ্তির হাসি হাসলেন। লেনিন ভাই পূর্ণ উদ্দোমে তাঁর গাড়ী ছোটালেন। শত্রুজিৎপুর, বেরইল, বাটাজোড়, অতঃপর ব্রীজ পার হয়ে ফুলবাড়ী হাতের বা পাশে রেখে আমাদের গাড়ি মহম্মদপুরের নহাটার ওখানে গাইড ঝন্টুর কথামতো দাঁড়িয়ে পড়লো। গরম ভাজা সিঙাড়া আর গরম জিলিপিতে উদর পূর্ণ করে আবার যাত্রা শুরু হলো।
অজগ্রামেও আধুনিকতার ছোঁয়া দেখতে পেলাম।বিদ্যুৎ সেবা গ্রামে পৌছে গেছে। সরকারের মেয়েদের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী করার যে সমস্ত ষ্ট্রাটেজি হাতে নিয়েছে, তার সুন্দর প্রয়োগ দেখে মনটা ভরে গেলো। যেমনঃ বই ফ্রি, কিছু আর্থিক সুবিধা দান, এমনকি মেয়েদের জন্য নাকি বাই-সাইকেল পর্যন্ত প্রদান করা হচ্ছে। একটা কিশোরীকে দেখলাম পড়ন্ত দুপুরে স্কুল ড্রেস পরে নির্জন গ্রামের পাকা রাস্তা ধরে কি অবলীলায় বাই-সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছে। কোন ইভটিজিং নেই, জড়তা, নেই, বখাটেদের উৎপাত নেই..দেখে খুব খুউব ভাল লাগলো। অথচ আমাদের ছেলেবেলা? শহরে জন্মে, বাস করে যেনো প্রাগৈতিহাসিক যুগের পশ্চাৎপদ মতাদর্শ নিয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে। মেয়েদের বাই-সাইকেল চালনা ছিলো অলীক স্বপ্নের মতন। বর্তমান সরকারের সকল সেক্টরে উন্নয়নের প্রচেষ্টা সমূহ স্পষ্ট আকারে পরিলক্ষিত হলো। কালভার্ট, সেতু তৈরি, খানাখন্দ, উচুঁ-নীচু পায়ে চলা পথকে মসৃণ করে পিচ ঢালাই দিয়ে পাকা রাস্তা হচ্ছে। এরফলে অবশ্যই শহর ও গ্রামের মাঝে সহজ সংযোগের সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে।
গাইড ঝন্টুর কথামতো মাগুরা জেলার শেষ সীমানায় মশাখালি গ্রামে আবার ক্ষণিকের যাত্রা বিরতি। গ্রামের মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসা মুগ্ধ করলো, একজন তো ষ্পটেই বেয়াইন হয়ে গেলো।
ফেরার পথে তার বাড়ীর পোষা মুরগী দিয়ে ভাত খাবার দাওয়াত দিলেন। কিছুক্ষণ হাসি আনন্দ করে অবশেষে আমরা বলাডাঙ্গায় এসে পৌঁছুলাম। রাস্তার এক পাশে গ্রাম অন্য পাশে বিল। যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধুই বিল। দূরে তাকালে মনে হয় দূর আকাশ বিলের সাথে মিশে গেছে। নৌকায় আমরা সবাই বিলের মাঝখানে চলে গেলাম। পদ্ম ফুল সব পূজার জন্য তুলে নিয়ে গেছে,তবুও বিলের সৌন্দর্য যতটুকু পারলাম আমরা উপভোগ করলাম। শ্যাওলা ভরা শীতল পানিতে হাত ভেজালাম, বড় বড় পদ্ম পাতাগুলো থালার মত পানির উপর পড়ে আছে, সেগুলো একটু ছুঁয়ে দেখলাম। ছোট বেলায় মিষ্টি কিনতে গেলে দোকানী আমাদের ওই পদ্মপাতায় মিষ্টি দিতো,, সেই স্মৃতি মনের কোনে
উঁকি দিলো। বিলের মাঝে নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে কয়েকটা লাল ফোঁটা পদ্মফুলের সন্ধান পেলাম। দেখতে কি সুন্দর!
স্মৃতি হিসেবে আমরা কয়েকটা পদ্ম তুলে নিলাম। এই ইছামতি বিল নড়াইল ও মহম্মদপুর এলাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আয়ের উৎসস্থল। পদ্মপাতা, মৎস আরোহণ, বিভিন্ন শাঁক, কলমি, হেলেঞ্চা শামুক,শাপলা ইত্যাদি ভোর থাকতেই সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। যেতে নাহি দেব… আর কত? শেষমেষ বিল থেকে উঠে এসে রাস্তার পাশে একটা গৃহস্ত বাড়ির সামনে আমরা হৈচৈ করছি, পথ চলতি কয়েকজন মানুষ আমাদের দেখে বাই-সাইকেল থেকে নেমে পড়লো, জানতে চাইলো, “আপনারা কনতে আইছেন” আমরা বললাম,“মাগুরা হতে আমরা এসেছি।”
মনে হলো খুব অবাক হয়েছে। এতদূর হতে ইছামতি বিল দেখতে এসেছি, মেনে নিতে পারছে না। ওদের মধ্য হতে, একজন বলেই উঠলেন, “উরে হাউস! মাগ্রো হতি এহানে আইছে!” বলে যার যার গন্তব্যে বাই-সাইকেলে উঠে চলে গেলো। আমরা তখন আর বলতে পারিনি, “হাউস মন ও শরীরকে সতেজ করে।”
ডাব খাওয়া পর্ব শেষ করে আমরা অন্যপথে মহম্মদপর উপজেলায় এসে মহম্মদপুর ও ফরিদপুর বোয়ালমারী উপজেলার সংযোগ সেতু এলাংখালি ব্রীজের উপর এসে নামলাম। এটাও খুবই সুন্দর ও মনোহরা! বিকেলের হাওয়ায় দেহ ও মনটাকে সতেজ করে আমরা সবাই মাগুরার ফেরার জন্য রওনা হলাম।
সুলতানা কাকলি: সাবেক গার্লস গাইড