অনন্যা হক : ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে স্বজন প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে মিলন উত্সব। এবার এমন কোন অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করছে না। এটাই বাস্তব সত্য। কারণ করোনা নামক এক ধরনের ভয়ংকর মহামারির সংকটের কবলে আমরা পতিত পুরো বিশ্ববাসী। একেবারে অপ্রত্যাশিত এবং আকস্মিক ভাবে এই করোনা এসে আমাদের জীবনকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।আজ বিশ্বের ঘরে ঘরে মৃত্যুর কান্না, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা। আমাদের দেশেও এর বিস্তার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।মৃত্যুর তালিকাও বড় হচ্ছে। এরকম একটা সময়ে মনকে কোন আনন্দ স্পর্শ করবে না।
করতে পারে না। যেখানে জীবনের এত গুলো বছর ধরে ঈদকে দেখেছি,পালন করেছি এক বর্ণাঢ্য আয়োজনে।
আমরা মুসলিমরা এক মাস ধরে সংযম সাধনার পর উন্মুখ হয়ে থাকি এই ঈদের জন্য। অতি উত্সাহের সাথে ঈদের বাজার, মজাদার পছন্দসই রান্না-বান্নার আয়োজন, নতুন পোশাক কেনাকাটার জন্যে শপিং এ যাওয়া, বাড়িতে আত্মীয় পরিজনদের কাছে ছুটে যাওয়া,সবার সাথে মিলিত হওয়ার চতুর্মুখি আনন্দ মনকে উজ্জীবিত করে রাখে।
আগামীকাল আমাদের সেই ঈদ। কিন্তু আজ এক চরম ক্রান্তিকাল পার করছি আমরা।করোনা মহামারী আমাদের মন থেকে, জীবন থেকে সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। আমরা এক কঠিন পরীক্ষায় নিপতিত হয়েছি। ঈদের অনুসঙ্গ হিসেবে যা আমরা করে থাকি, তার কোন কিছুই আমরা করতে পারিনি।
কিছুটা কষ্ট মনকে নাড়া দিলেও,আমি মনে করি এই কষ্টের থেকে আরো অনেক বড় কষ্ট অনেক ঘরে ঘরে মানুষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।নিজেদের অসুস্থতার কষ্ট, ঠিকমতো চিকিত্সা না পাওয়ার কষ্ট, অভাবের কষ্ট, সর্বপরি সব থেকে বড় বেদনা, নিজের কাছের মানুষকে হারানোর কষ্ট। তাদের কথা চিন্তা করে নিজেদের ঈদ আনন্দ নিয়ে ভাবাটাও আমার কাছে মনে হয় এক স্বার্থপর বাহুল্য মানসিকতার মতোই এখন।
আমরা বেশীরভাগ মানুষ এবার যার যার বাসায় বন্দী হয়েই ঈদ পালন করবো।কারণ এই মহামারির শর্তই হলো মানুষের সংস্পর্শে না যাওয়া, নিজেদের মঙ্গলের জন্যেই। এবারের ঈদ সাদামাটা ভাবেই হোক, তাতে কোন দুঃখ নেই।কারণ আমরা যারা বেঁচে আছি, এখনও সুস্থ আছি, এখনও পৃথিবী আলোর মুখ দেখছি,বাতাসে শ্বাস নিতে পারছি, এটাই আজকের এই পরিস্থিতি অনেক ভাগ্য, অনেক বড় রহমত।
আজ যে কষ্ট অন্য মানুষের সুখ কেড়ে নিচ্ছে, বিদীর্ণ করছে চরম নিষ্ঠুরতার সাথে, সেই কষ্ট কখন নিজের ঘরে হানা দেবে আমরা কেউ জানি না।
ঈদ, এবার একটা শব্দের মধ্যেই বন্দি হয়ে থাক।ঈদ সীমাবদ্ধ হয়ে থাক এবার শুধু সকলের মঙ্গল কামনার মধ্যে। বরং ঈদ আয়োজনে আমরা যে বাড়তি খরচ করে থাকি কম বেশী সবাই, সেই অর্থ কর্মহীন অভাবগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করে আমাদের ঈদকে আরো মহিমান্বিত করতে পারি।এটাও হবে আমাদের এক ধরণের ঈদ উদযাপন।এবং সেটাই করা উচিত্।
আজ সারা বিশ্বে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছে।বহু ঘরে অসুস্থ মানুষ জীবন নিয়ে ধুকছে। আমরা আজ শারীরিক, আর্থিক, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। সত্যি কথা হলো, কোন দিক দিয়েই ভালো নেই আজ আমরা।যেন পুরো বিশ্বের মানুষ হাঁটছি এক অজানা অন্ধকার পথ ধরে। আমরা আল্লাহ পাকের কাছে কৃপা ভিক্ষা করে যাচ্ছি একটু আলোর মুখ দেখার আশায়।
অগণিত মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে কিভাবে এই পরিস্থিতিকে জয় করা যায়, এই বিপদ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা যায়। সম্মুখ যুদ্ধে পরিশ্রম করে যাচ্ছে অগণিত মানুষ যারা ডাক্তার, সাংবাদিক, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আরো অনেকে। তাদের জন্য আমরা দোয়া করি।
আমরা বিধাতার কাছে নিজেদের সহ সকলের জন্য প্রার্থনা করি, এটাই হোক আমাদের এবারের ঈদ।
জানি না কবে শেষ হবে এই জীবন যুদ্ধ, এই কঠিন পরীক্ষা। তাই এবারের ঈদ হবে না কোন আনন্দের ঈদ,হবে না কোন মিলনের ঈদ। ঘরে ঘরে মানুষের কষ্টের, স্বজন হারানোর কান্নার সুর বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে।আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না এই কষ্টকে কোন ভাবেই। তাই চলো সবাই, আমাদের ধৈর্য, সংযম এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে এই করোনা মহামারী কালীন ঈদকে আমরা মহিমান্বিত করি।
ঈদের এই বিশেষ দিনে আমাদের প্রার্থনা হোক-ঈশ্বর তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করো, মঙ্গল করো, মুক্তি দাও এই কঠিন পরীক্ষা থেকে,পরিত্রাণ দাও এই গজব থেকে, শুদ্ধ, নির্মল জীবনের জন্য মানব জাতিকে সঠিক পথ দেখাও। ঈদ মোবারক।
অনন্যা হক: কবি, লেখিকা, আবৃত্তিকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী