অনন্যা হক : এই করোনা কালে প্রতিটি সকাল শুরু হয় একটা বিষন্ন মন নিয়ে। করোনা নামক বিভীষিকা আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাদের মন। বিপদ এখন সবার দরজায়। নিজের কথাই বলি হাসবেন্ড তাঁর কর্মস্থলে, পাশে নেই। এই সময়ে সেনাবাহিনীতে জরুরী ইস্যু ছাড়া কোন ধরনের ছুটি বন্ধ। সবার নিরাপত্তার কারণেই এই ব্যবস্থা। একটা মানবিক দিক সামলাতে গিয়ে আর এক দিকে অমানবিক-এ যেন অনেকটা এমনই।
আমার কাছে তাইই মনে হয়,যেন এক অমানবিক পরিস্থিতিতে পড়ে আছি, আমি আমার প্রিয়জনের সংস্পর্শে থাকতে বঞ্চিত হচ্ছি জীবনের সব থেকে এই কঠিন সময়ে। শুধু খেয়ে বেঁচে থাকাই তো জীবন নয়।কিন্তু এখন তাই হয়েছে। মানসিক বিষয়টাওতো অনেক জরুরী। কিন্তু মনের সবগুলো কপাট বন্ধ করে রাখতে হয়েছে। বেঁচে থাকা, সুস্থ থাকাই এখন সব-আর কিছুই করার নেই। অনেক দিন ধরে দুটো সন্তানকে সামলে একা চলছি।এর মধ্যেই করোনা নামক মহামারির কবলে পড়ে গেলাম।এমন অবস্থায় নিজের মন সামলে, সংসার আগলে সন্তানদের মানসিক, শারীরিক সব দিকে খেয়াল রেখে চলতে হয়। তাই বুঝতে পারি ভেঙে পড়লে চলবে না। এক বেলা মনকে বিষাদে ঘিরে ফেলছে, আবার নিজের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে চাঙ্গা করে তুলছি। সংসারে এখন কাজের চাপও অনেক বেশি।
সংগত কারণেই আমরা অনেকেই আমাদের কোন সাহায্যকারী বাইরে থেকে বাসায় আনতে পারছি না।মানসিক চাপের সাথে আছে কাজের চাপ। প্রতিকূলতা এখন প্রতি পায়ে পায়ে।
এক অদৃশ্য জীবাণুর বিরুদ্ধে এক অলিখিত যুদ্ধ চলছে। যে সে যুদ্ধ নয়।বাঁচা মরার যুদ্ধ। আজ এত বছর জীবন পথ পাড়ি দিয়ে এতদূর পর্যন্ত এলাম,কত রকমের পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে। কোন কিছুই এখনকার পরিস্থিতির সাথে তুলনাযোগ্য নয়। কল্পনার অতীত এক সময়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছি।যদি ভাবতে বসি তাহলে বিষাদের চোরাবালিতে হাবুডুবু খেতে হবে।কিন্তু দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে হাল ছেড়ে তো দেয়া যাবে না।জীবনে অন্ধকার নেমে এলেও আবার আশায় বুক বেঁধে আমরা আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি।এটাই জীবন।
চারিদিকে শুধু ভয়াবহতার ছবি।প্রিয় জনকে হারানোর বেদনার হাহাকারে ডুবে আছে সমগ্র পৃথিবী।দেখতে পাচ্ছি এই মহামারিতে অসংখ্য পুরুষের প্রাণহানি হচ্ছে।মহিলাদের থেকে তুলনামূলক অনেক বেশি।মাথার উপর থেকে ছাদ ভেঙে পড়ছে, জীবন পথে এক সাথে চলার সাথী হারিয়ে ফেলছে অগণিত মানুষ। যাদের এখন কোন ভাবেই চলে যাওয়ার কথা ছিল না। কখনও ভাবতে পারেনি কেউ।
অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় কষ্টের এসব ঘটনা দেখা বা জানার পর মনোবল ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা মাঝে মাঝে খুব নিষ্ঠুর ভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়।কত মানুষ প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণায় জর্জরিত হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে।আমাদের হাতে এই মুহূর্তে কিছুই নেই।শুধু আছে একটাই পথ,যতটা সাবধানতা অবলম্বন করে চলা যায়,যতটুকু সচেতন থাকা যায়।
যুদ্ধটা এখন সকলের যার যার দিক থেকে তার তার মতো করে চলছে।একই সাথে চলছে জীবনের ভয়,চলছে জীবিকার ভয়। একটা ভয় সব থেকে বেশি কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে অহর্নিশ, সে হলো কাছের মানুষ হারানোর ভয়। এই ভয়ই যেন জীবনকে গ্রাস করে ফেলেছে সবার।
আজ তিন মাস হলো আমাদের জীবনে এক সাথে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক গুলো দরজা। যেতে পারছি না নিজের বাড়িতে, নিজের শহরে, দেখতে পারছি না আপনজনদের মুখ,যেতে পারছি না বন্ধুদের সংস্পর্শে।সবাই থেকেও যেন নেই কোথাও।মনে হচ্ছে একদম একাই যেন এসেছি এই পৃথিবীতে। মানুষ যখন চিরতরে চলে যায়,তখন সে অসীম একাকীত্বের ভেতরে হারিয়ে যায়।এখন শুধু মনে হয়,এ তো চলে যাওয়ার আগেই একা হয়ে গেলাম সবাই।
প্রতিটা সকাল শুরু হয় একটা বিষাদময় দিন সামনে রেখে।সত্যি কথা বলতে মন ভালো থাকা সম্ভব নয়। এক চরম নিষ্ঠুর খেলায় জীবন নিমজ্জিত এখন। এই কি আমাদের সেই সাধের জীবন, আহা আমাদের কত প্রিয় মায়াবী জীবন! এই নিষ্ঠুর ভয়ংকর পরিস্থিতির ভেতরে সংসার,সন্তান, স্বামী সহ সকল প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে বেঁচে থাকার আশা হৃদয়ের কোণে এক টুকরো জ্বলন্ত সলতের মতো ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে। আর এই পৃথিবীর মায়ায়, মানুষের মায়ায় বাঁচতে সাধ হয় বলেই আবার হতাশাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কাজে মগ্ন হই। সুস্থ থাকতে ইচ্ছে করে প্রিয়জনের মুখ দেখার আশায়।ইচ্ছে করে সহধর্মির পাশে থেকে জীবন চলার পথ ধরে হেঁটে যাই আরো কিছু পথ।সন্তানের প্রতি থাকে মায়ের অগাধ স্নেহ,মায়া,মমতা আর ভালোবাসা।থাকে দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ।ইচ্ছে করে তাদের জীবনের সাথে থেকে সমস্ত বাঁধা বিপত্তি, প্রতিকূলতা থেকে আগলে রাখতে।
একজন নারী, একজন মা তার এ ভাবেই তার চিন্তার ভেতরে আবর্তিত হতে থাকে। এখন আমরা কেউ জানি না আমাদের সামনে কি আছে।আর জানি না বলেই বোধহয় ভেবে কোন কূল কিনারা করতে পারবো না।
এখন যুদ্ধ আমাদের জীবনের সাথে, যুদ্ধ আমাদের অদৃশ্য জীবাণুর সাথে, সব থেকে বড় যুদ্ধ আমাদের নিজের মনের সাথে। নিজের মনের কাছে কোন ভাবেই হার মানা যাবে না।একটা অন্ধকার পথের দরজা খুলে গিয়েছে যেন। মৃত্যু দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে।কখন কার দরজায় টোকা দেবে আমরা জানি না।ভবিতব্য সব জানে।
যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, অন্ধকারে আলো দেখার আশা করাই জীবন। আমাদের আশার সলতে জ্বলতে থাক, আমরা আমাদের জীবন পথ ধরে চলতে থাকি।
অনন্যা হক : কবি, লেখিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী