জাহিদ রহমান : ফুটবলের মহাতারকা মেসির ফুটবল জীবনে যে অপূর্ণতা ছিল আজ তা শতভাগ পূর্ণ হয়েছে। ক্যারিয়ারের গোধূলীলগ্নে এসে মেসির আরাধ্য স্বপ্নপূরণ হয়েছে। কোপা কাপের ফাইনালে আজ চিরপ্রতিদ্বন্ধী ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্জেন্টিনা। তাও আবার খোদ ব্রাজিলের মাঠেই ব্রাজিলকে পরাজিত করে। আর তাই এই চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা ফুটবল ইতিহাসে অন্যরকম গুরুত্ব ও উদাহরণ হয়ে থাকবে। ২৮ বছরের দীর্ঘ খরা কাটিয়ে আর্জেন্টিনা জিতল কোপা কাপ। স্বভাবতই এই বিজয় সারা বিশ্বের কোটি কোটি আর্জেন্টিনা ভক্তকে ভীষণরকম আনন্দিত না করে পারেনি।
খেলার প্রথমার্ধের ২২ মিনিটের সময় মাঠের ডান পাশ দিয়ে আর্জেন্টিনার ডি মারিয়া বিচক্ষণতার সাথে গোল করেন। এরপর দুদলই কয়েটি গোলের সুযোগ তৈরি করলেও কেউ সফল হতে পারেনি। তবে খেলার শেষ দিকে মেসি পেনাল্টি বক্সে ব্রাজিলের গোলরক্ষককে একা পেয়েও গোলে বল প্লেস করতে ব্যর্থ হন। ফাইনালেও আর্জেন্টিনার গোলপোস্টে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ দারুণ কূশলতার পরিচয় দিয়ে নিজের যোগ্যতাকে আরও তুলে ধরেছেন।
এবারের কোপা কাপের শুরু থেকেই চ্যাম্পিয়নের লক্ষ্য নিয়ে মেসি ভীষণরকম লড়াকু মেজাজ নিয়ে খেলতে থাকেন এবং দলকে নেতৃত্ব তেন। প্রতিটি ম্যাচেই অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় মনপ্রাণ উজাড় করে খেলেন তনি। দুর্দান্ত গোলও উপহার দিয়েছেন। সেরা গোলদাতার পুরস্কারও পেয়েছেন। আজকের লড়াই-এ মেসি না নেইমার জিতবেন এ নিয়ে সারা বিশ্বে ছিল তুমুল উত্তেজনা। তবে শেষমেশ জয়ী হয়েছেন মেসি। ফুটবল ক্যারিয়ারে সব পেয়েও দেশের জন্য কোনো ট্রফি জিততে না পারায় ভীষণ অতৃপ্ত ছিলেন ফুটবলের মহাতারকা লিওনেল মেসি।
আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার কিনা সেটা ইতিহাস মূল্যায়ন করবে । তবে অভাবনীয় দক্ষতায় যে কোনো ম্যাচকে যে তিনি দ্রুত বদলে দিতে পারেন সে প্রমাণ রেখেছেন অসংখ্যবার। মেসির ফুটবল শৈলি নিয়ে তাই ঘোর শত্রু বা সমালোচকও মাথা নত করতে বাধ্য। ফুটবলে বিরল এক প্রতিভা হিসেবেই এসেছিলেন। ফুটবলে জীবনে মেসি পেয়েছেনও অনেককিছুই। বিশেষ করে ক্লাব পর্যায়ে তাঁর সাফল্য সীমাহীন। গুচ্ছ গুচ্ছ সাফল্য। সাফল্যের যেনো শেষ নেই। কিন্তু দেশের জন্য তিনি ছিলেন ট্রফি শূন্য। নিন্দুকেরা তাই বরাবরই এই খোটা তাঁকে দিয়েছেন। এই অতৃপ্তির কথা মেসি নিজেই বহুবার বলেছেন। কোপা শুরুর পর বলেছিলেন, ‘কিছুই চান না, কোপার ফাইনাল ট্রফিটা জেতাই তাঁর মূল লক্ষ্য। এটি পেলেই তিনি খুশি।’
আসলেই মেসির বর্ণিল ফুটবল জীবনে এক অতৃপ্তি বিরাট কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবারই তাঁর হাত থেকে ছুটে গেছে বিশ্বকাপ, কোপা কাপের ট্রফি। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের কথাই ধরা যাক। সেবার বিশ্বকাপ ফুটবলে দুর্দান্ত শক্তি প্রদর্শন করে ফাইনালে উঠে আসে মেসির আর্জেন্টিনা। স্বপ্নপূরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু ১৪ জুলাই ভালো খেলেও ফাইনালে হারতে হয় জার্মাানের কাছে। এদিন ব্রাজিলের মারকানা স্টেডিয়ামে খেলার অতিরিক্ত সময়ের ১১৩ মিনিটে জার্মানির বদলি খেলোয়াড় মারিও গোটসে আচমকা গোল করে মেসিকে হতাশায় ডুবিয়ে দেন। ১৪ সালে বিশ্বকাপ জিতলে পারলে মেসির জীবনে আর কোনো অপূর্ণতা থাকতো বলে মনে হয় না।
একইভাবে পরপর দুবার কোপাকাপের ট্রফি হাত ছাড়া হয়ে যায় শুধুমাত্র ভাগ্য সহায়তা না করার কারণে। ২০১৫ সালে কোপা কাপের ট্রফি হাত ছাড়া হয়ে যায় মেসির টাইব্রেকারের লড়াই-এ । ৪ জুলাই গোল শূন্য ম্যাচে চিলির কাছে ট্রাইব্রেকারে (৪-১) হেরে ট্রফি ছাড়া ফিরতে হয়। পরের বছর ২০১৬ সালের ২৭ জুন সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেমিফাইনাল পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলার পরও ফাইনালে সেই একইভাবে চিলির কাছে টাইব্রেকারে (৪-২) হারতে হয়। মেসির দুঃখময় দিনের তালিকা যেনো আরও দীর্ঘ হয়। বিষন্ন বদনেই ফিরতে হয় মেসিকে। মেসির কোপা ভাগ্য যে খুবই খারাপ তা বলতে দ্বিধা নেই। মেসির অধিনায়কত্বেই আর্জেন্টিনা ২০০৭ সালে কোপা কাপের ফাইনালে উঠে। প্রতিপক্ষ হিসেবে আসে ব্রাজিল। ১৫ জুলাই ভেনেজুয়েলাতে অনুষ্ঠিত এ ম্যাচে ব্রাজিল ৩-০ গোলে জয়লাভ করে চ্যাম্পিয়ন হয়। ব্রাজিলের পক্ষে গোল করেন জুলিও বাপ্টিস্তা, রবার্তো আয়ালা এবং ডেনি আলভেস। গোল শূন্য থাকেন মেসি। দেশের পক্ষে একটি বিশ্বকাপ এবং তিনটি কোপা কাপের ফাইনালসহ মোট যে চারটি ম্যাচে পরাজিত হয়ে তাঁকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে সেই ম্যাচে তিনি কোনো গোল করতে পারেননি।
অথচ ক্লাব ফুটবলে মেসি কী করে দেখাননি। ফুটবলে জগতের অনেক বিস্ময় তিনি উপহার দিয়েছেন। ২০০৩ সালের ১৬ নভেম্বর মাত্র ১৬ বছর বয়সে এক নতুন ইতিহাস রচনা করে বার্সালোনার পক্ষে তাঁর অভিযেক ঘটে। প্রথম ম্যাচ খেলেন পর্তোর বিপক্ষে। ক্লাবের পক্ষে মেসির সাফল্য নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। কারণ এখানে তিনি এতেটাই আলোকময় তা বলে শেষ করবার নয়। বার্সেলোনার হয়ে তিনি চ্যাম্পিয়ন লীগসহ মোট ১৭টি ফাইনালে অংশগ্রহণ করেছেন। বার্সালোনার পক্ষে ৩৪টি টাইটেল জিতেছেন তিনি। ক্লাসিকোর লড়াই-এ তাঁর গোলসংখ্যা ২৬। লা লীগাতে তাঁর হ্যাট্রিক সংখ্যা ৩৬। বার্সালোনার পক্ষে তাঁর মোট গোলের সংখ্যা ৭৭৮। এরমধ্যে অফিসিয়াল গোল ৬৭২।
মেসি কোপা ফাইনালের আগ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে মোট ৭৭টি গোল করেন, খেলেন ১৪৯টি ম্যাচ। আর্জেন্টিনার ক্যাপ্টেন হিসেবে মেসি অবিভ‚ত হন ২০১১ সালে কলকাতার মাঠে। কলকাতার সল্ট লেকে ভেনেজুয়েলার সাথে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ হয়। সেই ম্যাচে নেৃতত্ব দেন মেসি। বিশ্বকাপ ফুটবলে মেসি প্রথম গোল করেন সার্বিয়ার বিপক্ষে। গ্রæপের দ্বিতীয় খেলায় রডরিগেজের বদলি হিসেবে নামেন ৭৫ মিনিটে । মঠের নামার তিন মিনিটের মধ্যেই হার্নান ক্রেসপোর করা গোলে এসিস্ট করেন। এরপর ৮৮ মিনিটের সময় দলের পক্ষে ষষ্ঠ গোল করেন। আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২০১২ সালে প্রথম হ্যাট্রিক করেন সুইজারল্যান্ডের সাথে এক প্রীতিম্যাচে। ব্রাজিলের বিপক্ষে তার একটা হ্যাট্রিকও আছে ২০১২ সালে আমেরিকাতে একটি প্রীতিম্যাচ হয়। সে ম্যাচে ৪-৩ গোলে ব্রাজিলকে পরাজিত করে আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসি হ্যাট্রিক করেন। এরপর ২০১৮ সালে হ্যাট্রিক করেন বিশ্বকাপে। মোট হ্যাটিকের সংখ্যা ৬। বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত মেসির গোল সংখ্যা ২৩টি।
মেসির ফুটবল জীবনে এতদিন যে অর্জন ছিল তা আজ আরও রঙিন, আরও বর্ণিল হলো কোপা কাপ জয়ের মধ্যে দিয়ে।
জাহিদ রহমান : সম্পাদক, মাগুরা প্রতিদিন ডটকম