সুলতানা কাকলী : আশির দশকের কথা। আমরা তখন মাগুরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী।কিচিরমিচির আর শত স্বপ্ন দেখা জীবন। সে সময়ে স্কাউট এর প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট স্টিফেনসন লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল এর সদা প্রস্তত মন্ত্রে দিক্ষিত হলাম।যুক্ত হলাম স্কুল গার্লস গাইডে ।গার্লস গাইড শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ এবং অনন্য নেতৃত্ব তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মাঝে।
বহতা নদীর মতো বয়ে চলেছে দিন, কাল, বছর। আজও গার্লস গাইডের সেই মধুর স্মৃতিগুলো হাতরে খুঁজি জীবনের পাতায়। স্কাউট যুব বয়সীদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও আবেগীয় দিকগুলোর পরিপূর্ণ বিকাশে অবদান রাখে যাতে করে তারা ভারসাম্য পূর্ণ দায়িত্বশীল সুনাগরিক হিসাবে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য হিসাবে অবদান রাখতে পারে।
মার্চ মাস শুরু হয়েছে। কিছুদিন পরই আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। আজ খুব মনে পড়ে স্কুল জীবনের গার্লস গাইডের সেই মধুর দিনগুলোর কথা। আশির দশকে মাগুরা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে আমার নেতৃত্বে ইয়েলো বার্ড ও গার্লস গাইড দল গঠন হতো।আমরা ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বর মাগুরার কোর্ট ময়দানে কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে দেখিয়ে বিজয়ের বেশে আনন্দ মিছিল করে বহুবার স্কুলে ফিরেছি।
মনে পড়ে সেই ড্রাম বাজানোর স্মৃতিময় দিনগুলো। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে ইনস্ট্রাক্টর কফিলউদ্দিন স্যারকে আমাদের স্কুলে একমাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ড্রাম বাজানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। স্কুলের অনেক ছাত্রীর মাঝে বাছাই করে তিন জনের একটি দল গঠিত হলো। সে দলে আমার সাথে আরও ছিল বীথি (ইসলামপুর পাড়া), আর রিতা (টাউন হল ক্লাবের পিছনে থাকতো, আজিজ ডাক্তারের মেয়ে)।আমাদের এই তিনজনকে নিয়ে শুরু হল ড্রাম বাজানো শিক্ষার প্রশিক্ষণ। এক মাস ধরে সকাল, দুপুর, বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা প্রশিক্ষণ। অক্লান্ত পরিশ্রম করে ড্রাম বাজানো প্রশিক্ষণ শেষ করলাম। এরপর কুচকাওয়াজ হলে আমার নেতৃত্বেই থাকতো আমাদের গার্লস গাইডের দল।
আমাদের দলের শিউলি, ডিনা, লুনা, বিউটি, দিনা, ইভা, রত্না, বুলবুলি, কবিতার কথাও ভীষণ মনে পড়ছে।এঁরা সবাই ছিল গার্লস গাইডের উল্লেখযোগ্য সদস্যবৃন্দ। আর শিক্ষিকাদের মধ্যে সাহিদা আপা, লতিফ স্যার, বুড়ি আপা-আমাদেরকে আদর-ভালবাসা দিয়ে সব সময় গাইড করতেন। সার্বক্ষণিক সাথে থাকতেন। প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা মরহুমা মনোয়ারা আনসারের কথা ভুলব না।
আমাদেরকে নিজের সন্তানের মতো সব সময় খোঁজ খবর নিয়ে সহযোগিতা করতেন। প্রধান শিক্ষিকার দুই কন্যা লোটাস আপা এবং লিনা আপা বিভিন্ন গানের সাথে শাড়ি নৃত্য, বাঁশ নৃত্য করতে সহযোগিতা করতেন । আসলে তখন ছিল না ছোটো বড় কোনো ভেদাভেদ। সবার ছিল একটায় উদ্দেশ্য কিভাবে আমরা আমাদের স্কুলের জন্য সুনাম ছিনিয়ে আনবো।
২৬শে মার্চ এবং ১৬ই ডিসেম্বর এলেই আমাদের নেতৃত্বে স্কুলের মেয়েদের মার্চপাস্ট আর বিভিন্ন ডিসপ্লেতে অংশগ্রহণ ছিল নিয়মিত। সেই কোন আমলের কথা।ড্রামের তালে তালে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এমপি, ডিসি, এসপিদের সামনে ড্রাম বাজিয়ে কতো না প্রশংসা পেয়েছি। মাগুরা শহরে কখনও কোনো মন্ত্রী মহোদয় এলে মঞ্চের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে গার্লস গাইডের মেয়েরা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিতো।
আসলে গার্লসগাইডের সেই দিনগুলো ছিল অন্যরকম। ক্যাম্পিং এর সময় যেনো আরও মজা হতো। স্থানীয়ভাবে তিনদিন বা সাতদিন ব্যাপী মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নোমানি ময়দান, ও একাডেমি বিদ্যালয়ে ক্যাম্পিং হতো। সারাদিন থাকতো বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ। সন্ধ্যা থেকে শুরু হতো আগুন জ্বালিয়ে ক্যাম্প ফায়ার। এ ছাড়াও থাকতো বিভিন্ন স্কুলের মধ্যে প্রতিযোগিতামুলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটিকা।
আশির দশকে গার্লসগাইডের হয়ে গাজীপুরের শফিপুরে জাম্বুরি ক্যাম্পেও অংশগ্রহণ এ জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায়। জাম্বুরিতে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা থেকে আসতো গার্লস গাইডরা। কুচকাওয়াজসহ সারাদিনের কার্যক্রম শেষে সন্ধ্যায় শুরু হতো ক্যাম্প ফায়ার। প্রতিটি জেলার মেয়েরা তাদের নিজেদের নানাবিধ কসরত দেখাতো। এছাড়াও বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকতো সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে অক্ষর আদান প্রদান, গান বাজনা, কৌতুক, নাটিকা ইত্যাদি।
আজ খুব মনে পড়ে স্মৃতি গুলো। সব সময় ভেবে গর্ব বোধ করি আমরা বাঙালি। আমরা বাংলায় কথা বলি। আমরা স্বাধীন। বহু মায়ের কোল খালি করে, অবুঝ শিশুর বাবাকে হারিয়ে শত-সহস্র বোনের সম্ভ্রম এর বিনিময়ে পেয়েছি এক টুকরো স্বাধীন মাটি, লাল সবুজের পতাকা।
পেয়েছি নিজের ভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার। পেয়েছি ২১শে ফব্রুয়ারী, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর। এই সকল দিবস বুকে লালন করি সর্বদা। এইসব দিনকে সন্মান জানাতে গার্লস গাইড-এর মেয়েরা সদা প্রস্তুত থাকে।
গার্লস গাইড-আমার তারুণে ভরা দিনের একখণ্ড ভালবাসা। আমি এখনও হ্নদয়ে অনুভব করি ভাললাগা আর অনিঃশেষ ভালবাসায়।
সুলতানা কাকলী: লেখিকা, সাবেক গার্লস গাইড, মাগুরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়