অনন্যা হক : সুমন চাটুজ্জের গান যখন কানে বাজে ‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই-তখন খুব বেশি মনে হয়, কোনো খোলা দোকানে চা খাওয়া, আর সাথে আড্ডা দেওয়ার মজা তুলনাহীন। মানুষের সুস্থ থাকার জন্য আড্ডা আর একরাশ হাসি, যে কোন দামী ওষুধের থেকে বেশি কার্যকরী। যখন একটা গুমোট, গোমড়া পরিবেশ নিজের চারিদিকে তৈরি হয় তখন সেটা শরীর, মন দুটোর উপরেই প্রভাব ফেলে। মানুষের মন এমনই অদ্ভুত।
হয়তো জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব আসে মনে, অথবা কোন নেতিবাচক বোধ উপদ্রবের মত হানা দেয়, তখন একাই মন বিমর্ষ হয়ে ওঠে। এটা মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি হয়, কারণ আমরা সংসারে চতুর্মুখি দায়িত্ব পালনে আবদ্ধ থাকি, একঘেয়ে ভাবে নিরন্তর।
আমার মনে আগে থেকেই একটা ব্যাপারে বেশ আক্ষেপ ছিল, যেটা হলো চায়ের দোকানে বসে চা পান আর আড্ডা নিয়ে। আমি মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা এক নারী। সেখানে আগেও দেখেছি, এখন গেলেও দেখি এই চায়ের দোকানের আসরে, ছেলেদের জীবন উপভোগের বিষয়টা, যেটা আমার খুব নজর কাড়ে বরাবরই।
জীবনের সব কিছুর পক্ষপাতিত্বের কিন্তু একটা সীমা থাকা উচিত। আমাদের মহিলাদের ক্ষেত্রে সত্যি এই সীমাটা অনেক ব্যাপারেই অতিক্রম করে যায়। সব সময় ছেলেদের চায়ের দোকানের আড্ডাটা, ওদের জন্য একটা বিরাট সুবিধা এবং বিনোদনের ব্যাপার বলে মনে হয় আমার কাছে।
এটা একভাবে ওদের জীবনীশক্তির যোগানদাতা হিসাবে কাজ করে। ওদের কখনও মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকতে হয় না। ভালো লাগছে না, বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে, কিছু সময় আড্ডা, সাথে চা ,বেশ মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। এসব যেন ওদের জন্যই নির্ধারিত। বেশ আগে থেকেই ছেলেরদের চায়ের দোকানের আড্ডাটায় আমার বেশ হিংসা এবং ক্ষোভ কাজ করে। শুধু মনে হয়, এরকম মোড়ে মোড়ে মেয়েদের চায়ের দোকান জন্মের পর থেকে কেন দেখলাম না! তাহলে শুরু থেকেই জীবনটাকে বেশ উপভোগ করার সুযোগ পেতাম।
ঘরে গুটিয়ে থাকতেই যেন আমাদের জন্ম। এই পৃথিবীর আলো, হাওয়ার রসদ থেকে আমাদের বঞ্চিত করার অধিকার তো আসলে কারো থাকার কথা নয়।
আমরা যখন বাসায় দায়িত্ব পালন করে একঘেয়ে, ক্লান্ত হয়ে যাই, তখন চলে যেতে পারি সোজা চায়ের দোকানে। কত অচেনা মানুষের অজানা গল্প, মতামত, নিত্য নতুন জীবনের অভিজ্ঞতা, সাথে চা, বিস্কুট, কলা, সিঙ্গারা, কত বৈচিত্র হতো জীবনে!
ভেবে দ্যাখো তো মেয়ে বন্ধুরা, পৃথিবীতে এত কিছু হলো, মেয়েদের জন্য এটা কেন হলো না? কোন সাহসী, মহিয়ষী, বেপরোয়া নারী এগিয়ে এলেই হয়তো আমরা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই সুখ টুকু ভোগ করতে পারতাম। খুব কিন্তু বড় কোন চাওয়া নয় এটা।
থাকতো যদি সত্যি এমন, যেদিন যে এলাকায় যেতে ইচ্ছে করবে রওনা দেবো। গিয়ে দেখবো আগে থেকেই বসে আছে এক এক দল সব চেনা, আবার অচেনা মেয়ে বন্ধুরা। চলবে চা এর সাথে তুমুল আড্ডা, হৈচৈ, হাসাহাসি, একটা প্রাণবন্ত জীবনের খোঁজ। জীবন, সংসার, সমাজ, দেশ নিয়ে নানাবিধ আলোচনা, সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে অনেক জটিলতার সমাধান। যেখান থেকে নারীদের মন বিকশিত হবে অবশ্যই।
দায়িত্ব পালন করতে করতে হাফিয়ে ওঠা মনটাকে একটু বিশ্রাম, বিনোদন তাদের জন্য হতেই পারে এক ক্ষুদ্র পাওয়া। সংসারের জটিলতার বেড়াজালে আবদ্ধ না থেকে একটা মুক্ত পরিবেশের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হোক না তাদের। যাই হোক এমন একটা আক্ষেপ এবং ইচ্ছে ছিল এতদিন।
এবার আমার নিজের শহরে গিয়ে সেই আক্ষেপকে চিরতরে মাটি দিয়ে এসেছি। প্রতি দিন গিয়েছি একদল মহিলা চায়ের দোকানে। আমার নিত্যসঙ্গী বন্ধু কাকলী, শিউলি, বিউটি, বিথী। চায়ের সাথে গরম চুলায় চা বানানো দেখতে দেখতে চলেছের আমাদের প্রাণবন্ত আড্ডা। সত্যি খুব উপভোগ করেছি। এবং অন্দরমহলে থেকে যেটা বুঝতে সুযোগ হয়নি, এক সীমাবদ্ধতার গন্ডিকে ভেঙে রাতের শহরে বাইরের জগতের সাথে মিশে গিয়ে নিজের শহরকে অন্য রকম ভাবে ভালোবাসার উপলব্ধি অর্জন করেছি।
শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত রত্ন কাকার চায়ের দোকানে গিয়েছি, যেখানে ছিল আমার আব্বার নিরন্তর যাতায়াত। ওখানে বসে খুব মনে পড়ছিল আব্বার কথা। গিয়েছি পূর্বাশা সিনেমা হলের সামনে হাছানের চায়ের দোকানে, যেটা বিখ্যাত রসমালাই চায়ের জন্য বিখ্যাত। তাদের জন্য রইলো আমাদের সকলের শুভ কামনা।
চলো ভেঙে ফেলি সব সীমাবদ্ধতার গন্ডি, শুরু হোক নতুন এক ইচ্ছে এবং ভালোলাগার সূচনা। যদি মন থাকে সুস্থ এবং সুন্দর, তো পরিবার এবং সমাজের উপকারই সাধিত হয় তাতে। যেখানে বিন্দু মাত্র ক্ষতি নেই কারো, সেখানে ভেঙে ফেলা হোক সব শৃঙ্খল!
অনন্যা হক: কবি, লেখিকা