আজ, সোমবার | ২৪শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | রাত ১০:৩৮


তিনজন সত্ লোকের সন্ধানও পাননি কুঁড়েঘরের মোজাফফর আহমেদ

জাহিদ রহমান : ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের কথা। এদিন অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯৩টি আসন আর ৪১.৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে ফের ক্ষমতার আসে বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ পরিচালনা শুরু করেন। এর আগে তিনি দুবার প্রধানমন্ত্রী হন।

তবে ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রয়ারি অনুষ্ঠিত কথিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাত্র কয়েকদিন। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো বিএনপি থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। কিন্তু বিএনপির প্রতিষ্ঠা দিবসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী কর্তৃক শ্রদ্ধা না জানানোকে কেন্দ্র করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। অবশেষে দলের নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়ে তাঁকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়। এর পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে সারাদেশে ক্ষমতাসীন বিএনপি আর বিরোধী দল আওয়ামীলীগের মাঝে বিভিন্ন বিতর্ক এবং পাল্টা আন্দোলন কর্মসূচি চলমান থাকে। তবে হঠাত্ করেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন দল বিএনপির গড়ফাদারদের একটি নামের তালিকা প্রকাশ করলে বেশ উতপ্ত হয়ে হয়ে উঠে রাজনীতির মাঠ। ক্ষমতাসীন দল বিএনপিকে বিপাকে ফেলতে ‘গডফাদার’ বিষয়ক ইস্যু অনেকটাই চমকে দেয় সবাইকে। ক্ষমতাসীন দলের ‘গডফাদার’-এই মুখরোচক বিষয়টি নিয়ে দু দলের মধ্যে টানটান উত্তেজনাও চলতে থাকে।

রাজনীতির ঠিক এরকম সময়ে ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, কমিউনিষ্ট অঙ্গনের প্রিয় ও পরিচিত মুখ, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা, ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ-এর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হই। তখন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ-এর বাসা কাকরাইলে রাজমণি সিনেমা হলের ঠিক ডান পাশে।

সাক্ষাত্কারের জন্য ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বেশ সরশ ভাষায় নানা প্রশ্ন করলেও সাক্ষাত্কার দিতে আগ্রহী হন। এক সন্ধ্যায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ-এর সাক্ষাৎকার নিতে তাঁর বাসায় যাই। বাসায় গিয়ে দেখি খুবই সাদামাটা এক বাসা, কোনো বাড়তি সাজ-সজ্জা নেই। বাসার অবয়ব দেখে মনে হচ্ছিলো-সত্যিই এটি কোনো কমিউনিস্ট নেতার সাদামাটা বাসাই। কিন্তু উনি যখন প্রথম আমাকে দেখলেন তখন মনে হলো বাকপটু এই রাজনীতিক খুব একটা আস্থা পাননি। হয়ত মনে মনে ভেবেছেন এই ছেলে ছোকরা সাংবাদিক উনার মতো একজন বর্ষীয়ান, বাকপটু রাজনীতিবিদের কী ইন্টারভিউ নেবেন। আর তাই আমার দেখে তাকিয়ে প্রথমে বললেন, ও আপনি এসেছেন। আমার ইন্টাভিউ লইবেন। কী ইন্টারভিউ লইবেন? সহজ ভঙ্গীতে এসব কথা বললেন। এরপর আবার বললেন বসেন। একথা বলে উনি একটু ভেতরে ঢুকলেন। বুঝলাম উনি খুব সম্ভবত আস্থা পাচ্ছেন না। এরকম পরিস্থিতিতে মনে মনে ফন্দি আঁটতে থাকলাম কী প্রশ্ন বা কথা দিয়ে শুরু করলে উনাকে দ্রুত বশে আনা যাবে।

তখন মনে হলো ৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন কালে তিনি একবার সেই সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রাতে এরকম মন্তব্য করেছিলেন যে, জিয়ার চেয়ে আমার চেহারা কী খারাপ। তাহলে কেন পত্রিকায় শুধু জিয়ার ছবি ছাপা হয়, আমার ছবি ছাপা হয় না। সে সময় উনার এই বক্তব্য বেশ বাজার পেয়েছিল মানে জনপ্রিয় হয়েছিল। ভাবলাম এই কথাগুলো দিয়েই উনার সাথে কথা বলা শুরু করবো, দেখি কী হয়।

কিছুক্ষণ পর অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ- ভেতর থেকে এলেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে উনাকে শুধু কাছ থেকে দেখিনি। উনার অনেক হাস্যরস যুক্ত বক্তব্য শুনেছি। এবার আমার পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলবেন বলেন? মোজাফফর আহমেদ-এর পরনে হাফ শার্ট আর লুঙ্গি। এবার আমি বললাম স্যার আমি আপনাকে অনেক আগে থেকেই চিনি। আপনি আমাদের নেতা। আপনার কথাগুলো খুব ভাল লাগে। ৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে আপনি একবার বলেছিলেন, ‘জিয়ার চেয়ে আমার চেহারা কী খারাপ। তাহলে কেন পত্রিকায় শুধু জিয়ার ছবি ছাপা হয়, আমার ছবি ছাপা হয় না। আপনার এই কথাটা মনে আছে। এ কথা শুনে উনি হেসে ফেললেন। বললেন, কী মিয়া তুমিতো দেখি পুরনো দিনের মানুষ। ভালই খোঁজখবর রাখ। উনার স্মিত হাসিমুখ দেখে বুঝলাম এবার আর অসুবিধা হবে না। উনি এ কথাতেই আমার উপর আস্থা রাখতে শুরু করেছেন। আশা করি ভাল একটা ইন্টারভিউ নিতে পারবো।

এবার শুরু হলো সাক্ষাৎকার পর্ব। মিনি ক্যাসেট প্লেয়ার অন করলাম। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো সাক্ষাৎকার গ্রহণ। প্রথম প্রশ্নটা করলাম আওয়ামী লীগের দেওয়া শাসক জোটের গডফাদার লিস্ট নিয়ে বিতর্কের কথা। হেসে বললেন, যাদের নামে লিস্ট বের করা হয়েছে তাদের উচিত আলাদা আরেকটি লিস্ট প্রকাশ করা। প্রকারান্তে বললেন, পারলে বিএনপিও একটি লিস্ট প্রকাশ করুক। পাল্টা লিস্ট প্রকাশ না করে বিএনপির মামলার পথে যাওয়া সঠিক হবে না। যায় হোক প্রশ্ন-উত্তর চলছে, এ প্রশ্ন সে প্রশ্ন। এবার সরকারি দল বিএনপি আর বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নানান প্রসঙ্গে তুলে বললাম, স্বাধীনতার পথ থেকে দেশে ক্ষমতায় যারা এসেছে, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রায় তারা একই ধারা অবলম্বন করেছে। তো বিএনপি-আওয়ামী লীগের বিপক্ষে আপনারা ( বাম দল সমূহ) কেন বিকল্প নেতৃত্ব গড়তে ব্যর্থ হলেন। এবার উত্তরে তিনি বললেন এভাবে, আপনি নিশ্চয় বামপন্থী দলগুলোর প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগা দেশ আর একই সঙ্গে দুর্ভাগা মুসলমান সমাজ। বামপন্থীদের যে সামান্য গুনাগুন থাকে আমাদের দেশের বামপন্থীদের মাঝে সেটাই নেই। আসলে আগের বামপন্থীরা যদি থাকতো মানে যাদেরকে দাদা বলা হয় অর্থাত্ স্বাধীনতার পরেও যারা এখানে বামপন্থী ছিলেন সেই মণি সিংহ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জী, এন চক্রবর্তী এরা থাকলে আপনার প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হতো না।

আপনি জানের এরা সবাই প্রয়াত হয়েছেন, কেউ দেশ ছাড়েন নি। এর বিপরীতে মুসলমান বামপন্থীরা হয়ে পড়েছে বেঙ্গল বাম, টাইগার বাম। আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে দুঃখ ভারাক্রান্ত হ্নদয়ে আমি বলছি আমি একজন মার্কসিস্ট হয়ে আরেকজন সত্যিকার মার্কিসিস্ট পাইনি। যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পরিস্থিতি মিলিয়ে আলোচনা করা যায়। আমাদের দেশে বামপন্থীরা বিকল্প হতে পারতো কিন্তু হয়নি, অন্য দেশে হয়েছে। ব্রািজলে বিকল্প হিসেবে লুলা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছে, তিনিওতো বামপন্থী। আমাদের দেশের বামপন্থীদের সম্পর্কে জানেন কিনা জানিনা-তারা আসলে মান-মানসিকতার দিক দিয়ে বামপন্থী হতে পারেনি। আর বামপন্থী রাজনীতি করতে এসে যদি কেউ প্রথমেই বলে আমার কী হলো, মানে আমার ভাগ্যে কী, তাহলে সে আর বামপন্থী থাকতে পারে না। আমার চোখ দিয়ে আমি এ পর্যন্ত যা দেখেছি তাতে করে আমি এখন কোনো বামপন্থী পাইনি যে বলে না আমার কী হইলো। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি প্রসঙ্গে টানলে তিনি বললেন, আমিতো সৎলোকের সন্ধান করছি। একটি পত্রিকা এ নিয়ে নিউজও করেছে। এদেশে সত্ লোকের দুর্ভিক্ষ চলছে। তিনটি সত্ লোকও পাওয়া যায় না। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তিনজন লোক লাগে। কিন্তু এই দেশে সেই তিনজনেরও বড় অভাব।

গত ২৩ আগস্ট অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চিরতরের জন্য বিদায় নেন। তিনি বিদায় নিলেও রাজনীতির ময়দানে তাঁর অনেক কথাই কানে বাজে। এ দেশে সত্ লোকের দুর্ভিক্ষ চলছে-তাঁর এই কথাটি পুরোটাই সত্য। সবখানে স‌ত্ লোকের বড় অভাব। একই সাথে এও সত্য রাজনীতি এখন ত্যাগের চেয়ে ভোগের বাসনাই বেশি। আর তাই রাজনীতি মানেই হলো ‘আমি কী পাইলাম। রাজনীতিতে সত্ লোক নেই, সত্ লোকের দুর্ভিক্ষ চলছে- এই আক্ষেপ তিনি করেছেন বহুবার। বেঁচে থাককালীন তিনি এনিয়ে বহুবার কথা বলেছেন প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে। তবে হ্যাঁ রাজনীতিতে পরিচ্ছন্ন নির্লোভ মানুষ হিসেবেই থেকেছেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। কুঁড়েঘর-এর মোজাফফর হিসেবে তাঁর যে সুগন্ধী তা হয়ত অনেক অনেক দিন থাকবে। কিন্তু এও সত্য কোনো রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তিনি রেখে যেতে পারেননি।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology