সুলতানা কাকলি : মাগুরার প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গীমোড়। এই মোড়ের উত্তর পশ্চিম কোণে যেখানে বর্তমান পুলিশ সুপারের কার্যালয় পুর্বে সেখানে লম্বা স্কুল ঘরের মতো একটা বিল্ডিং ছিল যেটাকে বলা হতো পুরাতন কোর্ট। এই কোর্ট সংলগ্ন ছিল পুলিশ ফাঁড়ি। এরা সব সময় শহরের শান্তি শৃংখলা রক্ষার্তে সদা সচেষ্ট ছিল।
পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং এর সামনে ছিল বিশাল এক খোলা চত্বর এবং প্রধান রাস্তার গা ঘেসে ছিল এক বিশাল বটগাছ৷ ওই বট গাছের ছায়ায় বসে অনেক পথিক বিশ্রাম নিতো। শান্ত স্নিগ্ধ মাগুরার প্রাণ কেন্দ্রের ওই বট গাছের নিচে শহরের বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর লোকের সমাগম হতো। কারণ, কোর্ট প্রাঙ্গণ চত্বরে বটের ছায়ায় নায়েব আলি, আকমল ওঝা, চেনিরদ্দি মজমা করে দাঁতের মাজন, সাপ খেলা দেখানো ও মানুষকে ধোকা দিয়ে বাগেরহাটের দরগার তাবিজ বলে বিক্রি করতো। ওদের পাশেই শুকুর আলি প্রতিদিন কৃমির ব্যানারটা নিয়ে কৃমির বড়ি বিক্রি করতো।
আমরা স্কুলে যাবার পথে প্রায়ই ওদের মজমায় অংশ নিতাম। কৈশরে এ সব দৃশ্য দেখতে ভাল লাগতো। শহরেরে সাধারণ মানুশেন বিনোদনেরও একটা অংশ ছিল এসব মানুষগুলো। শুকুর আলির কৃমির বড়ি বিক্রি করা কথা খুব মনে আছে। সে সুর করে বলতো-
“পেট গেছে গোয়ালন্দ মাথা গেছে চালনা
পাছা গেছে ঝালকাঠি দেখতে ব্যাঙের নমুনা
শুকুর মিয়ার কৃমির বড়ি
নিতে ভুলোনা।”
বটতলা চত্বরে একটু লোক সমাগম বেশি হলেই মজমা করে নায়েব আলী দাতের মাজন, চেনিরদ্দির তাবিজ বিক্রিও আকমল ওঝার সাপের খেলার জমজমাট আসর সারা বছর সকাল নয়টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত চলতেই থাকতো। আকমল ওঝা বেশ আগেই মারা গেছেন। অনেকেই তাঁকে সাপুড়ে আকমল হিসেবে চিনেন। বটতলার আর একটা আকর্ষণ ছিল আয়নাল ডাক্তারের একপাল ভেড়া। এই ভেড়ার দলঘুরে ফিরে বটের পাতা খেতো এবং সুশীতল ছায়াতলে বিশ্রাম নিতো। কালের বিবর্তনে সেই নায়েব আলী, আকমল ওঝা, চেনিরদ্দি, শুকুর আলী এবং সেই ভেড়ার পাল কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এখন শহরটাও বদলে গেছে।
বট প্রাঙ্গনটি ছিল সত্যিই যেন মাগুরার মানুষের মিলন মেলা। ওখানে মেলার মতোই ছিল সরগরম ও নানান রকম প্রাণবন্ত মনোমুগ্ধকর সব আয়োজন। আবার বটপ্রাঙ্গণটি ছিল নানান পেশার মানুষের আয় রোজগারের ও প্রধান উৎসস্থল। ওখানে রুটি, কুলফি, চা, বাদাম ভাজা, চাকভাজা, বারো ভাজা সবই বিক্রি হতো। এছাড়াও ছাতি সারানোর মিস্ত্রিরা সারি বেধে বসে থাকতো। আর ঋষিরা জুতা সেলাই, পালিশ-এর কাজ করতো। নিম্ন আয় করা মানুষদের আর ও একটি আকর্ষণের জায়গা ছিল, নিক্সন মার্কেট। ওখানে পুরাতন কাপড় বিক্রি হতো। এই মার্কেটে সারাদিন ভিড় লেগেই থাকতো। মাগুরার বাইরে শ্রীপুর, শালিখা, মহম্মদপুর থেকেও মানুষেরা আসতো এখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে।
বটতলা শুধু সারাদিন নয়, মধ্যরাত পর্যন্তও সরগরম থাকতো। এর আরেকটি কারণ হলো-আশির দশকে মাগুরায় খুব ধণীলোক ছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কারো বাড়িতে টেলিভিশন ছিলনা। সে সময়ে বিটিভি এবং সাদা-কালোর যুগছিল। তথ্য অফিসের সৌজন্যে সন্ধ্যা হলেই মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্য টেলিভিশন দেখার ব্যবস্থা করা হতো।
মাগুরার কলহল মূখর সেই বটতলা, সেই পুলিশ ফাঁড়ি, সেই পুরাতন কোর্ট, নিক্সন মার্কেট নেই। নায়েব আলি, আকমল ওঝা, চেনিরদ্দি-উনারাও হারিয়ে গেছেন। কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে এ সবই উজ্জ্বল। এখনও আলাপে আ্ড্ডায় এ সব স্মৃতি আমাদেরকে নিয়ে যায় সেই কৈশরে এবং তারুণ্যের দিনগুলোতে। সুলতানা কাকলি: লেখিকা