জাহিদ রহমান : মাগুরার কৃতিসন্তান প্রফেসর ড. এম.এ. জলিল আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন গত ৯ জুন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দ্রুত তাঁকে নেওয়া হয় ইবনে সিনা হাসপাতালে। এরপর শারিরীক অবস্থার আরও অবনতি হলে নেওয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ৯ জুন ওখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পরেরদিন ভোরে তাঁকে মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার বরিশাট গ্রামে নিজপাড়ার কবরস্থানে শায়িত করা হয়।
ড. এম. এ জলিল ঢাকাস্থ বৃহত্তর যশোরবাসীর কাছে ভীষণ এক প্রিয়মুখ ছিলেন। সবাই তাঁকে ভালবাসতেন শ্রদ্ধা করতেন তাঁর আলোকিত স্বচ্ছ জীবনাচার ও জ্ঞানমুখীতার কারণে। আমৃত্যু তিনি ছিলেন জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের এক নিরব কূশীলব। খুলনা, যশোর, মাগুরা যেখানে গিয়েছেন সেখানেই মানুষকে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণের তাগাদা দিয়েছেন। তিনি বলতেন সার্থক জীবন গড়তে অর্থবিত্তের চেয়েও অনেক বেশি প্রয়োজন জ্ঞান, সততা, সৃষ্টিশীল চিন্তা ও কর্মকূশলতা। এসবের বাইরে মানুষের বাহ্যিক বিত্তবৈভব অনাকর্ষণীয়। পরিবার, সমাজে, রাষ্ট্রে শিক্ষা এবং জ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগই হলো মূল সাফল্য।
যতদিন বেঁচেছিলেন নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে তিনি এই কথাগুলো বিলিয়েছেন। সমাজের ভেতরের আত্মশক্তি উন্মোচনে সারথী হয়ে থেকেছেন সবসময়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন ’আমাদের বাঁচিবার উপায় আমাদের নিজের শক্তিকে সর্বোতভাবে জাগ্রত করা।’কোনো জ্ঞানভিত্তিক প্রচেষ্টাকেই তিনি ছোট করে দেখতেন না। এসব কাজে বরবারই উৎসাহ দিতেন।
সেই ষাট দশকে তৎকালীন বৃহত্তর যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার শ্রীপুর থানার নিভৃতপল্লী বরিশাট থেকে তিনি কেবল মেধার জোরেই নগরে উঠে এসেছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মাগুরা কলেজ, এরপর দীর্ঘসময় রংপুর কারমাইকেল কলেজ, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে লোক প্রশাসন কেন্দ্র (পিএটিসি), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নায়েম)-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। সরকারি চাকরি জীবন শেষ হওয়ার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রাইম ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় অনুষদের ডীন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬-১৮ মেয়াদে ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি শিক্ষক সমিতির সভাপতি। আর মৃত্যু অব্দি বৃহত্তর যশোর জেলা সমিতি ও মাগুরা জেলা সমিতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। নিজ গ্রাম বরিশাটে ’বরিশাটে মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ গড়ে তুলতে উদ্যোক্তাদের সাথে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। টানা পনেরো বছর তিনি এই স্কুলের সভাপতি ছিলেন। এসবের বাইরেও আরও অনেক কিছুর সাথেই তিনি জড়িত ছিলেন। কিন্তু বরাবরই তিনি নেপথ্যে থেকে সবাইকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। কখনই প্রচারের আলোয় আসতে চাননি।
মুুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে সত্তর দশকের মধ্যভাগে ভারতের হায়দারাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থশাস্ত্রে শুধু পিএইচডি ডিগ্রীই অর্জন নয়, গোল্ডমেডালিস্ট খেতাব নিয়েও আসেন। সেই সময়ে মাগুরার অঁজপাড়ার আনাচে-কানাচে মেধাবীজন হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। স্কুল, কলেজের শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিতে তাঁর নাম উল্লেখ করতে থাকেন।
বালকবেলায় আমাদের কাছেই সত্যিই স্বপ্নের মতো নামটি শোনাতো ‘ড. এম.এ. জলিল’। অবশ্য এর অনেকগুলো সমাজ ও মনস্তত্ত্বও ছিল। ষাট-সত্তর দশকে গ্রামীণ সমাজকাঠামোতে অর্থনীতি ছিল একেবারেই ভূমিনির্ভর। যার যত জমি সমাজে তার ছিল তত সম্মান, প্রতিপত্তি। জমির মালিক বা ভূ-স্বামীরাই হতেন সমাজের মূলচালিকা শক্তি। এই শ্রেণীর বাইরে সমাজের অন্যান্য ক্ষুদ্র পেশাভিত্তিক মানুষের প্রভাব তেমন একটা ছিল না। সেসময় ভূমিহীন পরিবারগুলোকে খাদ্যচাহিদা মেটাতেই হিমশিম খেতে হতো। একই সাথে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অপ্রতুল হওয়ার কারণে গরিবের জন্য লেখাপড়া করাটাও ছিল প্রাণান্তকর এক লড়াই। কিন্তু সে লড়াই-এ জিতেছিলেন এই মানুষটি। একেবারেই নিজের চেষ্টায় লড়াই করতে করতে মেধার জোরে উঠে এসেছিলেন তিনি। সেই ষাট দশকে মাগুরার শ্রীপুর থানাতে মেট্রিক পরীক্ষাকেন্দ্র পর্যন্ত ছিল না। তখন মহকুমাতে এসে পরীক্ষা দিতে হতো। শ্রীপুর থানা সদরের আশপাশের গ্রাম থেকে মাগুরাতে পায়ে হেঁটে আসতে হতো টানা বারো থেকে চৌদ্দকিলোমিটার রাস্তা।
এরকম শত প্রতিকূলতা জয় করেই তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। কর্ম আর সততার এক অনন্য উদাহরণ রেখে গেছেন শিক্ষাবিদ ড. এম.এ. জলিল। সরকারি চাকুরি জীবনে সারাজীবনে নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন একনিষ্ঠভাবে। রাষ্ট্রের সাথে প্রতারণা করেননি এক মিনিটের জন্যেও। রাষ্ট্রের কাছ থেকে যতুটুক নিয়েছেন তার চেয়ে ঢের রাষ্ট্রকে প্রাণখুলে দিয়েছেন। কখনই গাড়ি-বাড়ি বা বিত্তবৈভবের চিন্তা করেননি। কিছু পাননি বলে হা পিত্যেশ করেননি। রাষ্ট্রে দায়িত্বে অবিচল থেকেছেন একনিষ্ঠভাবে।
সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন থেকেও সারাজীবনই পরিশীলিত, পরিমিত জীবনযাপন করেছেন। রাষ্ট্র বা সরকার থেকে কোনোকালে কোনো সময় অনৈতিক বা বাড়তি সুযোগ নেওয়াতো দূরে থাক, বরং নিজের প্রাপ্য সুযোগটুকুও উপেক্ষা করেছেন নির্বিবাদে। অবারিত সুযোগ থাকার পরেও সরকারের ফ্লাট, প্লট নেওয়ার জন্য কোনোদিন দৌঁড়াদৌড়ি করেননি। নীতি নৈতিকতার কাছে অনড় থেকে কারো কাছে হাত পাতেননি। উল্টো নিজের পেনশনের টাকা তুলতে রিকশা, বাসে চড়ে ব্যাংকে গিয়েছেন, আর দশটা মানুষের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন।
আসলে গাড়ি, বাড়ির চেয়ে উনি ভালবাসতেন একনিষ্ঠভাবে সততার সাথে কাজ করতে। মৃত্যুর আগেও যশোর-মাগুরার ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুসন্ধান করা, মাগুরা, শ্রীপুরের কোন লাইব্রেরিতে নুতন কী বই পাঠাবেন, শ্রীপুরের দ্বারিয়াপুরে সাধক-পীর তোয়াজউদ্দিন পাঠাগার আয়োজিত অনুষ্ঠানে কবে যাবেন-এসব যেনো উনাকে বেশি টানতো। কখনই যশোর, মাগুরাবাসীর কোনো অনুষ্ঠান মিস করতেন না। ঠিক সময়ে নিরবে এসে উপস্থিত হতেন।
ড. এম.এ. জলিল শুধু কর্মপ্রিয়ই নয় অনেকটা গণমুখীও ছিলেন। মানুষের সাথে নিরবে মিশতে, কথা বলতে চলতে ভালবাসতেন। নিজের ব্যক্তিগত অনেক কাজ তুচ্ছ করে তিনি সমষ্টির জন্যেই আত্মত্যাগ করতে ভালবাসতেন। বহুমাত্রিক কাজ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। এ কারণেই যশোর বা মাগুরাবাসীর দুর্দিনে সবসময় পাশে থেকে সুপরামর্শ দিয়েছেন। বৃহত্তর যশোর জেলা সমিতি ও মাগুরা জেলার সমিতির সাথে তিনি জড়িত ছিলেন মৃত্যুঅব্দি। সমিতির নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব তাঁকেই কমবেশি পালন করতো হতো। আবার সমিতি থেকে স্মরণিকা, সুভেনির যেগুলো বের হতো সেখানে তাঁর হাতের স্পর্শ থাকতোই। লেখা তৈরি, সম্পাদনা করা এসব কাজ করতেন খুব ভালবাসতেন। প্রফুল্ল হ্নদয়ে আনন্দচিত্তে এসব কাজ করতেন।
এসব কাজে সর্বশেষ নির্ভরতা ছিলেন তিনিই। আসলে সাংস্কৃতিক ও সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ হওয়ার কারণে সবকিছুতেই স্নিগ্ধরুপ দিতে তিনি আপোষহীন থাকতেন।
মননে-চিন্তায় আধুনিক এই অনন্য আলোকিত মানুষ সবসময়ই পরিবার থেকে শুরু করে পরিচিত বলয়ে সৃষ্টি আর স্নিগ্ধতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ কারণেই বোধ হয় তাঁরই ছোটকন্যা তাহসীনা শাহীনের ফ্যাশন হাউস ’সাদাকালো’ আজ পৃথিবীময় বিখ্যাত হয়েছে। ’সাদাকালো’র পোশাকের কদর আজ সর্বত্র। শুধু ছোটকন্যা তাহসীনা শাহীন বলে নয়, তাঁর চারকন্যাই আজ উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। চারজনই আলো ছড়িয়েছেন নিজ নিজ ভূবণে। তাঁর আরেক কন্যা লুনা শিরীন, কানাডা প্রবাসী। নিয়মিত লেখালেখি করেন প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। অন্য দুইকন্যাও আমেরিকা প্রবাসী। এই কৃতিমানকে পরিপূর্ণতা দিতে নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখেন তাঁর স্ত্রী হাজেরা বুলবুলি।
ড. এম.এ. জলিল শায়িত হয়েছেন কুমার নদের তীরে বরিশাট নিজগ্রামে পিতা-মাতার কোলেই। যে গ্রাম থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন নগরে, সেই নগর ছেড়ে তিনি আবার ফিরে গেছেন নিজগ্রামে তাল-তমালের ছায়ে। কুমার নদকেও তিনি খুব ভালবাসতেন। বাড়িতে গেলে কুমার নদের পাড়েই বসতেন গ্রামবাসীকে নিয়ে। করোনা দুর্যোগের কাল না থাকলে অসংখ্যজন যে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসতেন তাঁর কফিনে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই আফসোসটুকু সবার থেকেই গেল।
শেষবয়সেও এসেও মানুষ কতোটা কর্মমূখর, প্রাণবন্ত থাকতে পারে তাঁর অনন্য উদাহরণ তিনিই। নিয়মিত ধর্মাচার, জীবনবোধের দর্শনে একটা মানুষ কতোটা কতোটা উজ্জ্বলতরো থাকতে পারেন তাঁর উদাহরণ তিনিই। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর জীবন-সংগ্রামের গল্পগুলো আমরা যত বেশি তুলে ধরতে পারব ততই এ প্রজন্ম জ্ঞানে-গরিমায়, আদর্শে ঋদ্ধ হবে। লোকদেখানো বিত্তবৈভবের এইযুগে নিভৃতচারী, অনাড়ম্বর এই আলোকিতজন সততা এবং জ্ঞানশক্তির যে অনন্যতা রেখে গেলেন তার সীমাহীন মূল্য আছে। এরকম মানুষের ছায়াই নষ্ট-ভ্রষ্ট সমাজকে দেখাবে আলোর পথ। আমরাও আমাদের সন্তানদের কাছে গর্ব আর ভালবাসা নিয়ে বলতে পারবো আমাদের এক গুণীজন ছিলেন ’প্রফেসর ড. এম.এ. জলিল’।
জাহিদ রহমান: সম্পাদক, মাগুরা প্রতিদিন ডটকম