জাহিদ রহমান : বিশ্বকাপ ফুটবলের আজ অন্তিম দিন। মধ্যরাতের আগেই ফ্রান্স এবং আর্জেন্টিনার মধ্যেকার ফাইনাল লড়াই-এর মধ্যে দিয়ে কাতার বিশ্বকাপের সমাপ্তি ঘটবে। এই বিশ্বকাপে ফাইনালের আগ পর্যন্ত লিওনেল মেসি নিজের সামর্থ্যরে অনেককিছু দেখিয়েছেন। কিন্তু লিও’র সেই চোখ জুড়ানোর ফ্রি কিক এখনও দেখা যায়নি।
বিশ্বকাপে মেসি এখন পর্যন্ত পাঁচটি গোল করতে সমর্থ হলেও একটি গোলও করতে পারেননি ফ্রি কিক থেকে। অথচ বিশ্বকাপে আসার দু মাস আগেও জ্যামাইকার বিপক্ষে এক প্রীতিম্যাচে তাঁর করা ফ্রি কিক থেকে একটি গোল এসেছিল। সর্বশেষ গোলটি করেন ২৮ সেপ্টেম্বর জ্যামাইকার বিপক্ষে প্রীতিম্যাচে। এ ম্যাচে আর্জেন্টিনা জয়লাভ করে ৩-০ গোলের ব্যবধানে। ৮৯ মিনিটের সময় ফ্রি কিক থেকে মেসি অসাধারণ একটি গোল করেন। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে ফ্রি কিক থেকে মেসি কোনো গোল করতে না পারায় দর্শকদের মাঝে এক ধরনের আফসোস রয়েই গেছে।
মেসির ফ্রি কিকের গল্প নতুন নয়। তাঁর অলোৗকিক সব ফ্রি কিকের রূপচ্ছটা ফুটবল দর্শকরা অনেকদিন ধরেই দেখে আসছিল। মেসির ফ্রি কিক বরাবরই ‘ট্রেডমার্ক’ হিসেবেই গণ্য। বহু বহুবার প্রমাণ করেছেন নির্ভুল নিশানায় তিনি অনন্য। ইমপ্রেসিভ ডিসপ্লেতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ফ্রি কিক থেকে মেসির করা গোলের সংখ্যা বর্তমানে ৬০।
ফুটবল লড়াই-এর অপার সৌন্দর্য গোল। ফুটবল গোলের খেলা। দিন শেষে ফুটবলে গোলই যেনো সব। গোল ছাড়া ফুটবল ম্যাচ বরাবরই ম্যাড়মেড়ে মনে হয়। গোল দেখার জন্যই ফুটবল দর্শকরা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। ফুটবলে যত ধরণের গোল কোটি কোটি দর্শকদের রোমাঞ্চিত করে ফুটবলের পরিভাষায় সেটি ‘ডিরেক্ট ফ্রি কিক’। প্রত্যক্ষ বা সরাসরি কিকে যে গোল হয়। তবে এখানে ফিফার কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।
ফিফার নিয়ম অনুযায়ী ডিরেক্ট ফ্রি কিকের বেলায় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা ৯.১৫ মিটার বা দশ গজ দূরে দাঁড়াতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা গোলকিপারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ওয়াল তৈরি করেন। আর যিনি কিক নেন তিনি খুঁজেন নির্ভুল নিশানা।
ফ্রি কিকের রেকর্ডটা মেসির প্রথম দখলে আসে গতবছরের ৪ জুলাই রবিবার সকালে কোপা কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলায়। এদিন ইকুয়েডরের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। ডি-পল এবং মার্টিনেজ দুই গোল করে দলকে এগিয়ে রাখে। কিন্তু মেসির জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ আসে অতিরিক্ত সময়ের খেলায়। শেষ বাঁশি বাজার কিছু আগে ডি-মারিয়াকে ফাউল করার অপরাধে ব্রাজিলিয়ান রেফারি উইলটন সামপিও ভিএআর ( ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি) দেখে আর্জেন্টিনার পক্ষে ফ্রি কিকের সিদ্ধান্ত দেন। গোলকিপার হারনান গালেন্ডেজ এর সামনে ইকুয়েডরের সব খেলোয়াড় ওয়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মেসির বিদ্যুৎ গতির চোখ ধাঁধানো শট গোলপোস্টের টপ রাইট দিয়ে জালে জড়িয়ে পড়ে। এই গোল দিয়ে সেসময় মেসির ফ্রি কিক থেকে পাওয়া গোলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৮।
মেসিই সমসাময়িক কালে ফ্রি কিকে সেরা। ৬০ গোলের মধ্যে মেসি ৫০টি করেছেন বার্সালোনার পক্ষে, একটি পিএসজি-এর পক্ষে, বাদবাকি ৯টি দেশের পক্ষে। তবে ইকুয়েডরের মধ্যেকার ম্যাচের আগে চিলির সাথে গ্রুপের যে খেলা আর্জেন্টিনা ১-১ গোলে ড্র করে সেই ম্যাচেও কিন্তু ফ্রি কিক থেকে আরেকটি মনোমুগ্ধকর গোল করেছিলেন। খেলার ৩৩ মিনিটে ২৫ গজ দূর থেকে নেওয়া শটে মেসি চিলির গোলকিপার ক্লাউডিয়া ব্রাভোকে পরাস্ত করেন।
সমসাময়িক কালে ফ্রি কিক-এর লড়াই-এ মেসির পরেই রয়েছেন ফুটবলের আরেক মহাতারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তিনিও অবশ্য কম যাননি। পরিসংখ্যানে খুব একটা পিছিয়েও নেই। রোনালদো এ পর্যন্ত ফ্রি কিক থেকে মোট ৫৮টি গোল করেছেন। এর মধ্যে নিজ দেশের পক্ষে করেছেন ১০টি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পক্ষে করেছেন ১৩টি, রিয়েল মাদ্রিদের পক্ষে করেছেন ৩২টি, আর সর্বশেষ জুভেন্টাসের পক্ষে করেছেন ১টি গোল। অবশ্য এই দুই জনের ধারের কাছে এখন আর কেউ নেই। সবাই যোজন যোজন দূরে। তুরস্কের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হাকান চানাহানোলুর আছেন তৃতীয় স্থানে। গোল সংখ্যা মাত্র ২৮। এরপরে ২৬ গোল করে চতুর্থ স্থানে রয়েছেন বসনিয়ার মিডফিল্ডার মিরালেম পিয়ানিচ। ২২ গোল করে পঞ্চম স্থানে সার্বিয়ার ফ্রি কিক মাস্টার আলেজান্দার কোলারেভ। কিন্তু এতক্ষণ যাদের কথা বললাম এরা কিন্তু উত্তরসূরিদের থেকে এখনও অনেক অনেক পিছিয়ে। শীর্ষ দশে এখনও ঠাঁই হয়নি। কবে ঠাঁই হবে সেটা গলা বাড়িয়ে বলার অবকাশ নেই।
ফ্রি কিক এর গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসে ৭৭ গোল করে সবার সেরা ব্রাজিলের জুনিনহো পারমানবুকানো। একসময় ব্রাজিলের মধ্যমাঠের নয়নতারা ছিলেন। ক্লাব পর্যায়ে দীর্ঘদিন খেলেন ফ্রান্সের অলিম্পিক লিও এবং নিজ দেশের ভাস্কো দা গামা ক্লাবে। এই ক্লাব থেকেই ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে অবসর নেন ২০১৪ সালে। জুনিনহোর করা ফ্রি কিক-এর ইতিহাস এখনও অক্ষত। জুনিনহোর পরে ধারাবাহিকভাবে রয়েছেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলে (গোল ৭০), আর্জেন্টিনার ভিক্টর লেজেরোতাজলিয়ে (গোল ৬৬), ব্রাজিলের রোনালদিনহো (গোল ৬৬), ইংল্যান্ডের ডেভিড বেকহ্যাম (গোল ৬৫), আর্জেন্টিনার ডিয়াগো ম্যারাডোনা (গোল ৬৫), ব্রাজিলের জিকো (গোল ৬২), হল্যান্ডের রোনালড কোয়েম্যান (গোল ৬০), ব্রাজিলের মার্সেলিনহো কারিওকা (গোল ৫৯) এবং ব্রাজিলের রোজারিও (কেনি) (গোল ৫৯)।
এবারের বিশ্বকাপে ফ্রি কিক থেকে মেসি গোল করতে না পারায় সবার মাঝে অতৃপ্তি রয়েই গেছে। আজ যদি সত্যি সত্যি কোনো ফ্রি কিক থেকে মেসি গোল করেন, যদি আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়-তাহলে কেমন হয়!
জাহিদ রহমান: সম্পাদক, মাগুরা প্রতিদিন ডটকম