আজ, রবিবার | ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | রাত ৩:২১

ব্রেকিং নিউজ :

বন্ধু ……. অনন্যা হক

অনন্যা হক : কেমন আছিস শ্রাবণী? সেই কৈশোরে তোকে ছেড়ে এসেছিলাম। মাঝে একবার তোকে দেখেছিলাম, সেই নিরু দিদির বিয়ে তে।

সিঁথি তে সিঁদুর, কপালে একটা লাল টিপ। জ্বলজ্বল করছে তোর মুখ টা, সদ্য বিবাহের আমেজে। খুব হাসিখুশি মুখে কথা বলছিলি। আমাকে বললি, বড্ড অসময়ে বিয়ে টা করে ফেলেছিস, পাশের বাড়ির এক ছেলে কে।

তোকে বেশ সাহসী দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমার অচেনা কেউ। অথচ এক সময় খাওয়া আর ঘুম ছাড়া,কত সময় পার করেছি শুধু তুই আর আমি। বাসা থেকে একটু ছুট পেলেই, সেই সবুজ ঘাসে মোড়ানো মাঠের আনাচে কানাচে, লাগোয়া পুকুরের কাঠের পাটাতনে বাঁধানো ঘাটে, পানিতে পা ডুবিয়ে বসে গল্প করা, গাছের ডালে বসে বরই খাওয়া, টিনের চালে ওঠা, পাঁচিলের উপর হেঁটে বেড়ানো, পাবলিক লাইব্রেরির বারান্দায়, নির্জন দুপুরে গুটি আর তেক খেলা। অযথাই মাঠে, আগান বাগানে ঘুরে ফ্রকের আঙিনা ভরে চোরা কাঁটা বিঁধিয়ে ঘরে ফেরা। আরও কত কি যে বলে শেষ করা যাবে না। যখন কৈশোরে তুই আমি পায়ে পায়ে ঘুরেছি, কখনও ভেবে দেখিনি যৌবনের কোন এক ক্ষণে এসে কত বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের দুই বাসিন্দা হয়ে যাব। তাই জানতে পারিনি তোর এই গোপন অভিসার জীবনের মাঝে ঘটে যাওয়া কোন কাহিনী।

এক সময় আমাদের মন জুড়ে শুধু বন্ধুত্বের মোহজালে আবদ্ধ ছিলাম আমরা। যখন অন্য পাড়া তে বসবাস শুরু করলি, যৌবন যখন আমাদের কে বিধি নিষেধের বেড়াজালে আটকে ফেললো, তখন তোর মনের আঙিনায় কে ঢুকে আসন গেড়ে বসেছিল, সেটা জানার সৌভাগ্য আমার আর হলো না। আমি তোর খোঁজ এখনও রাখি। আজ তিরিশ বছর তোর দেখা পাইনি। শুনেছি বাড়ির সবাই টের পেয়ে গেলে, দুই বাসার কেউ তোদের বিয়ে টা কে মেনে নেয়নি। তুই একটা চাকরি নিয়ে দূরে অন্য শহরে চলে গিয়েছিলি। একটা বড় দুরত্ব হয়ে গেল তোর আর আমার মধ্যে । আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আর জানা হোল না, আমরা কে কেমন আছি। আজ খুব মনে পড়ছে তোকে। মনে পড়ে কত কথা যখন একাকী নিভৃতে থাকি, কিংবা কোন কাজের ফাঁকে। বিশেষ করে একলা অলস দুপুরে তুই এসে ভর করিস এই মনে।

জীবনের প্রথম সব সম্পর্কের একটা আলাদা মোহ থাকে, বন্ধুত্বেরও। কাজের শেষে অলস দুপুর গুলো তে সবাই হয়তো ঘুম অথবা একটু গড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হতো। আর আমি আর তুই উদ্বিগ্ন হয়ে থাকতাম কখন একসাথে হব। আর সুযোগ পেলেই শুরু হতো আমাদের আকাশ, বাতাস, গাছ, মাঠ, প্রান্তরের সাথে সখ্যতা। মনে আছে তোর, আমরা যখন ক্লাস এইটে, একদিন পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখি, ঘাসের উপর একটা চিঠি পড়ে আছে। তুলে দেখি আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। তুই আর আমি কত কৌতুহল নিয়ে চিঠি টা পড়েছিলাম। সে কি সব সাংকেতিক ভাষায় লেখা ছিল, যার অর্ধেক কথাই বুঝতে পারিনি। তারপর কি হেসে লুটোপুটি দুজনে। পরে ছিড়ে পানিতে ভাসিয়ে দিলাম। তখনও আমরা ফ্রক পরে বেণী দুলিয়ে ঘুরি। সে বয়সে প্রেম? প্রেমের কিই বা বুঝতাম! তাই তো খুব মজা পেয়েছিলাম। হঠাত্ করেই তোরা দূরে অন্য পাড়ায় চলে গেলি। একটা ছন্দ পতন হোল জীবনের। তোর জীবনে কি হোল, হঠাত্ করে কে এল, কোথায় গেলি কিচ্ছু জানতে পারলাম না। জানার আগেই তুই অনেক দূরে চলে গেলি। প্রায় দশ বারো বছরের স্মৃতি, একেবারে আষ্টেপৃষ্টে চলা, আমি তো কিছুই ভুলতে পারি না । মনে পড়ে সেই কাগজের জুতার বাক্স তে করে পুতুল খেলার কথা? কাপড় আর পাটকাঠি দিয়ে নিজে হাতে পুতুল বানিয়ে কলমের কালি দিয়ে চোখ মুখ এঁকে নিতাম।স্বামী, স্ত্রী, বাচ্চা বানিয়ে, ঘর সংসার, পুতুল বিয়ের খেলা খেলেছি কত। কাজের ফাঁকে, অলস দুপুরে, আমার চোখে সব ভাসে। মন টা বিষাদে ভরে যায়।সব ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। তখন কেন এমন খেলা খেলতাম? ঐটুকু মনে এসব কেন আসতো, কেন বড় দের জীবন নিয়ে এত কৌতুহল হোত? মনে হতো যেন কবে বড় হব, কবে বড় দের মত জীবন যাপন করতে পারবো, মনে হতো যেন, কত অপার সুখ লুকিয়ে আছে তাদের জীবনের অন্তরালে। এখন তো এই জীবনের মধ্যেই আছি। সেই অবুঝ ছোট্ট মন টা পরিপূর্ণতা পেয়েছে, কত অজানা কে জেনে ফেলেছি। তাই তো আবার সেই পেছন টানতে থাকে,ফিরে পাব না আর, যা কিছু ছেড়ে এসছি। এমনই জীবনের রহস্য, যেন শুধু মরীচিকার পিছে ছোটা ! শুনেছি তুই ফিরে এসেছিস আবার আমাদের শহরে।

আমার হঠাৎ ইচ্ছে করে তোকে গিয়ে বলি, ঠিক সেই অলস দুপুরে–চল বের হই, ঘুরে আসি, আমাদের কৈশোরের সেই চরে বেড়ানোর জায়গা গুলো তে। কিছুক্ষণ ঘাটে পা ডুবিয়ে বসবো, কিছুক্ষণ গাছের ডালে, টিনের চালে বসবো, কিছু সময় পাঁচিল দিয়ে হাঁটবো আর শাড়ি তে চোরা কাঁটা ফুটিয়ে, মাঠে, বাগানে ঘুরবো। তুই কি বলবি, আমার বর বাসায় রে, আমি যেতে পারবো না? পাগল হয়ে তো বিয়ে করেছিলি অসময়ে, সেই ঘোর এখনও আছে তোর? কিন্তু আমি জানি, তুই যাবি । ফেরাতে পারবি না আমাকে। তুই, আমি বের হব, হেঁটে যাব রাস্তা ধরে, অনেক জমানো কথা বলতে বলতে। খুব ভাল লাগবে, কিন্তু মন টা বিষাদে ভরে যাবে, কারণ আমরা কেউ খুঁজে পাচ্ছি না, সেই পুকুর ঘাট, সেই মাঠ, বাগান, সেই বরই গাছ, লাইব্রেরির বারান্দা। আর টিনের চাল? এখন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, বড় বড় অট্টালিকা।

আমরা এলোমেলো ভাবে, অচেনা লোকের ভিড়ে ঘুরে, যার যার গন্তব্যে ফিরে যাব। আসলেই সব মরীচিকা! ভাল থাকিস। তবে আমি আসবো ।

অনন্যা হক: কবি, লেখিকা

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology