অনন্যা হক : সকালের আলো জানালার ফাঁক গলে ঢোকার আগেই ঘুম ভেঙে যেত। বলছি সেই বালিকা বেলার কথা।
রক্ষণশীল পরিবেশে বেড়ে ওঠা মন খুঁজে বেড়াতো, একটু স্বাধীনতা। স্কুলে যাওয়া টা ছিল লেখাপড়ার পাশাপাশি সেই স্বাধীনতার আস্বাদ পাওয়ার এক ক্ষেত্রও বটে। ছিল এক অন্যরকম আকর্ষণ। মনে হতো কখন দশ টা বাজবে। তার আধা ঘন্টা আগেই রওনা দিতাম। স্কুলের পোশাক ইস্ত্রি, জুতো রেডি করা,সব নিজেরাই করতাম। নীল, সাদা সমন্বয়ে তৈরী স্কুল ড্রেস টা এখনও মনে দাগ কেটে আছে জ্বলজ্বল করে। বালিকা বয়স টা জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ সময়। নীল,সাদা শুভ্রতায় বেণী দুলিয়ে মেয়ে রা স্কুলে যেত পরিপাটি সাজে।
সকাল ন’টা থেকে দশ টার মধ্যে শহরের অলিগলি সব দিকে একই দৃশ্য। পায়ে হেঁটে, রিকশা চেপে বা দূর গ্রাম থেকে ভ্যানে চেপে। আমাদের এলাকা থেকে ছিল না খুব বেশী দূরের কোন পথ। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ছিল আমাদের স্কুল –মাগুরা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়।পায়ে হাঁটা পথ, পায়ে হেঁটেই যেতাম। বাড়ির সামনের লাল খোয়ার রাস্তা ধরে যেত অগণিত মেয়ে রা। কেউ বা বলিষ্ঠ পায়ে হেঁটে, কেউ লতার মত ধীর গতিতে হেলে দুলে, কেউ বা বিষন্ন মনে একা, কেউ বা বন্ধু দের সাথে খলবলিয়ে কথা বলতে বলতে।কিন্তু প্রশ্নই আসে না, কোন পুরুষ বন্ধুর সাথে। কারণ,তখন মাগুরা ছিল কঠিন বেষ্টনী তে ঘেরা এক মফস্বল শহর। এক পাক্ষিক বা দ্বি-পাক্ষিক ভাবে কেউ কাউকে পছন্দ করলেও, থাকতো হয়তো দূরে দাঁড়িয়ে, কিংবা মৃদু গতিতে সাইকেলে চেপে চলতো, বা গলির মোড়ে, চায়ের দোকানে তৃষিত চিত্তে বসে থাকতো, কেবলই মনে রঙ লাগানো প্রেয়সী কে দেখার একটা ছোট্ট বাসনায়। কিন্তু খুব সাবধানে, যেন কেউ দেখে না ফেলে, বুঝে না ফেলে।
হয়তো নিজের স্কুল, কলেজ ফাঁকি দিয়ে হলেও দাঁড়িয়ে থাকতো কেউ।ঐ বয়স টাই তো ছিল বোকা হবার বয়স। এখনকার মত এত অবলীলায় পাওয়ার কিছু ছিল না। ছিল সারা মাগুরা বাসীর,পরিচিত জনের, অভিভাবক, টিচারের অগ্নিদৃষ্টি সাথে সাথে। সবাই সবাইকে চিনতো, এমনই ছিল শহরের ধারা তখন। আমাদের পাড়া টার নাম ছিল কলেজ পাড়া। ঐ কলেজ পাড়া টা ছিল যেন টিচার দের অভয়ারন্য। যেন তাদের সুখের আবাস স্হল।আর আমাদের ভয়ের অরন্য, পিঠে পিঠে দৃষ্টি, অনুশাসনের বেড়াজাল। চলতে ফিরতে, আগে পিছে টিচার থাকতেন কেউ না কেউ যখন তখন। ওখানে থাকতেন টিচার দের মধ্যে আনোয়ারা আপা, হোসনে আরা আপা, সুপিয়েন্নেসা আপা, জোছনা আপা, জাহান আপা,রিজিয়া আপা, আর ছিলেন মসিউর রহমান স্যার প্রমুখ। এসবের মধ্যেই বেড়ে ওঠা, তবুও স্কুল জীবনের ছিল কি অদম্য আকর্ষণ। এখন বুঝি, আসলে যত বাঁধা, তত আকর্ষণ থাকে জীবনে। ঐ আটপৌরে শহর এখনও তেমন মনে ছবি হয়ে গেঁথে আছে। তাই তো ঘুরে ঘুরে অনুভবে এসে কড়া নেড়ে যায়।
স্কুলে যেতে, স্কুলের পথ ধরে হাঁটতেও এত ভাল লাগতো তখন! আমি এখনও দেখতে পাই আমাদের যাওয়া দিব্য চোখে। কখনও বা একা অথবা দলবদ্ধ ভাবে। রোদ হোক, মেঘ,বৃষ্টি যাই হোক, কি সিরিয়াস আমরা তখন, স্কুলে যেতেই হবে। এ কি শুধু লেখাপড়ার আকর্ষণ? কখনও না,খুব একটা মনের সুখে ক জনেই বা লেখাপড়া করে। যেতাম স্কুল প্রাঙ্গণের মজার টানে, বন্ধু দের টানে, স্বাধীনতার টানে, প্রাণের টানে। দিন চলে যায় বানের জলের মত। বয়ে যাওয়া জলের কলকল ধ্বনি শুনি। কখনও আনন্দে আত্মহারা হই, কখনও ধ্বনি তে বাজে, বিষাদের সুর। ফেলে রেখে যায়, স্মৃতির পলি। জমে যাওয়া পলিতে ভাস্বর উজ্জ্বল হয়ে থাকে অমলিন স্মৃতি।
আজ মনে পড়ে, সেই প্রাচীর ঘেরা সবুজ ঘাসের মাঠ, একটা কাঠের চিপা দরজা দিয়ে ঢুকতেই পেতাম দাঁড়িয়ে গোপাল দা,সাথে তার অমৃত স্বাদের আইসক্রিম! ছোট একটা চারকোনা বাক্সে আবদ্ধ সেই বরফ জলের ছিল কত কদর, শুধুই চিনি মেশানো বরফ জল,তবুও কত আকুতি ছিল মনে, যদি পয়সা পেতাম তো প্রতিদিন, আহা! ছিল খুব প্রিয় চাক ভাজা। ঢুকেই সামনে ছিল টিচার্স রুম, ছিল কিছু ফুল গাছ, চারিদিকে ঘুরিয়ে এধারে ওধারে বিল্ডিং।ছিল দোলনা, ছিল একটা পানির কল। পেছনে ছিল একটা পুকুর। মনে পড়ে, কত বসেছি, কত প্রাণের কথা, মনের কথা বলেছি বন্ধু দের সাথে। কি কথা আদান প্রদান হতো সেই অপরিণত কচি মনে, আজ আর মনে পড়ে না তেমন। তবে এটুকু মনে পড়ে, খুব কাছের কোন বন্ধুর তখনও মন দেয়া নেয়া হয়নি কারো সাথে, তবে এই নিষিদ্ধ জগত নিয়ে ছিল অদম্য কৌতূহল, সে সব নিয়ে হতো গোপন আলাপন। ছিল দোতলা ভবন, তার বিখ্যাত দোতলার বারান্দা। যার একবারে কোনায় গেলে একটা খোলা শহর চোখের আওতায় এসে যেত আমাদের। সেই দোতলার বারান্দা,যার কোনার দিকে যাওয়া যেন ঘোর অপরাধ ছিল আমাদের। গেলেই দেখতে পাব অগণিত পুরুষের মুখ, অথবা তারা দেখবে আমাদের অমূল্য বদন, যেন বালিকা মহল এক নিষিদ্ধ জগত! মনে পড়ে একসাথে এসেম্বলি তে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। ছিল অনেক শৃংখলা, ছিল কঠিন বেষ্টনী, অনেক অগ্নিদৃষ্টি, ধমকের ভয়, তবুও যেন এক প্রাণের মেলা, এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ।
উন্মুখ মন অধীর হয়ে থাকতো, কখন পড়বে টিফিনের ঘন্টা, ঢং ঢং ঢং ঢং ….এক ঝাঁক বালিকার এক ছুটে মাঠে আসা, কালজাম, চমচম, কমলা ভোগ, সিঙ্গারার জন্য বুভুক্ষু হৃদয়,যেন কত সুস্বাদু সে খাবার! কল চেপে আজলা ভরে পানি খাওয়া, দোলনা তে দোল খাওয়া, মনে পড়ে, কত শত মুখ, সিনিয়র, জুনিয়র মেয়ে দের কে, কখনও প্রকট কখনও ঝাপসা, ভেসে ওঠে।
সব টিচারের মুখ গুলো, মনে পড়ে –বড় আপা মনোয়ারা আনসার ছিলেন আমাদের সাথে অনেক দিন। পন্ডিত স্যার,গীতা আপা,বুড়ি আপা, সাহিদা আপা,ফরিদা আপা, শেখর স্যার, অতুল স্যার, লতিফ স্যার, ভোলা স্যার, মনি মার কথা যার নাম ছিল কমলা বালা দত্ত। আরো অনেক শিক্ষক, শিক্ষিকা দের কথা। রঘু দার বিশাল অবয়ব। হরিপদ দা মানে ঘন্টা হাতে। প্রিয় ঘন্টা, ছুটির ঘন্টা, টিফিনের ঘন্টা। এমন অসংখ্য স্মৃতি। একটা বিশাল সময় জুড়ে ছিলাম গার্লস গাইড নিয়ে ব্যস্ত।ষোলই ডিসেম্বর, ছাব্বিশ মার্চ মানে সে কি উৎসব মুখর আয়োজন। এখনও রক্তে দামামা বেজে ওঠে। শুনতে পাই ড্রামের শব্দ, দেখতে পাই পতাকা হাতে হেঁটে যাওয়া, পায়ে পায়ে তাল মিলিয়ে কুচকাওয়াজের পদধ্বনি কানে আসে। ছিল সমকক্ষ স্কুলের সাথে অন্য রকম প্রতিযোগিতা। সে কি দিন, কিছু কি ভোলা যায়? ফিরে আসে মনে দশ থেকে পনেরো, ষোলর সেই দুর্নিবার আকর্ষণের সময় টা। স্মৃতির আখরে ফিরে আসে বারবার। এমন অনেক অনেক কথা মনের অলিগলি তে জমা করে রেখে এই পরিণত মনের মাঝে লুকিয়ে থাকে এক বালিকা মন।
একদিন বালিকা ছিলাম,
উঁকি দেয় মনে যখন তখন।
একাল থেকে সেকাল ছুটে চলে মন,
দেখে বালিকা বেলার স্কুল প্রাঙ্গণ।
হৈচৈ, ছুটোছুটি, অকারণে হাসাহাসি,
কিছু না করেও,পায়ে পায়ে দোষ দেখি।
তবু যেন বাঁধ ভাঙা জোয়ারে
ভাসতে শিখি।
লেখিকা-অনন্যা হক