সুলতানা কাকলি : সময়ের সাথে সাথে জাগতিক সব কিছু যেমন পাল্টাতে থাকে তেমনি ভাবে ভাষার বিন্যাস, শব্দ, বাচন ভঙ্গি সমুহ পাল্টাতে থাকে। এমন কী অনেক শব্দ চিরতরে হারিয়েও যায়। এ ব্যাপারে ভাষাবিদগণ সবচেয়ে ভাল বলতে পারবেন। এসব চিন্তা আমার মতন ক্ষুদ্র মানুষের মগজে ঢোকার কথা নয়।কিন্ত গত ঈদুল আজহায় পোতা ছেলের আব্দারে হঠাৎ করেই মনে এই চিন্তাটা চিরস্থায়ী আসন গেড়ে বসলো। আমাদের বাংলাভাষা হতে ক্রমে ক্রমে সবার অগোচরে অনেক শব্দ বোধহয় চুপিসারে হারিয়ে যাচ্ছে!
‘আম্মু আমি মেলায় যাবো।’ পোতা ছেলের এই আব্দার তার জন্মদাতা করোনার জুজুর ভয় দিয়ে থামিয়ে দিলো। “মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো! ভাবলাম, করোনা জীবনের কত ছোটখাট ব্যাপার গুলোকে, আবেগ, আনন্দ, ভালবাসাকে প্রতিদিন গলা টিপে হত্যা করে চলেছে! দাদার কল্যাণে পোতা ছেলে নাচতে নাচতে হাত ধরে নোমানী ময়দানে চলে গেলো মেলা দেখতে। ফিরে এলো একগাদা চকলেট ও নাগরদোলায় চড়ার সুখ স্মৃতি নিয়ে।
ছোটবেলায় আমাদের মহল্লার সমবয়সী সাথীদের নিয়ে হৈচৈ করতে করতে আড়ংয়ে যাবার স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। আর ঠিক তখুনিই মনে হলো, ‘আড়ং’ শব্দটা কি মাগুরার বহুল প্রচলিত শব্দের মধ্য থেকে অগোচরে হারিয়ে গেছে? ঠিক বুঝতে পারছিনা! আজকাল সব শ্রেণী ও বয়সের মানুষের মুখে আড়ং শব্দের পরিবর্তে “মেলা” শব্দটির বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে আমি খেয়াল করছি। এ ধারণা ভুলও হতে পারে। তবে এটা সিওর যে, বহুদিন কারো মুখে “চল আড়ং-এ যাই” এ কথাটি একদমই শুনতে পাইনি। আড়ং এর স্থলে মেলা শব্দটা কখন আমাদের ভাষায় বহুল পরিচিত শব্দ হয়ে আসন গেড়ে বসেছে,এটা খুবই চিন্তার বিষয়। তবে আমার মনে হয়, বৈশাখী মেলা যেদিন থেকে আমাদের দেশে পালন করা শুরু হয়েছে, হয়তো সেদিন থেকেই আস্তে আস্তে আড়ংয়ের পরিবর্তে মেলা শব্দটা আসন গেড়ে বসেছে। আমি নিজেওতো আড়ং শব্দটা একদম ভুলে গেছিলাম।
মনটা নষ্টালজিক হয়ে গেলো। আমাদের শৈশবে মেলা বলতে আমরা আড়ংকে বুঝতাম। মহল্লার সমবয়সীরা একসাথে দলবেঁধে আড়ংয়ে যেতাম! কত রকম বাহারি জিনিসপত্র আড়ংয়ে উঠতো তার ইয়ত্বা নেই। এক পাশে ময়রাগণ জিলিপি ভাঁজতো, হরেক রকম মিষ্টান্ন বিক্রি করতো। বুন্দিয়া, জিলিপি, কদমা, বাতাসা, কটকটি, গজা, তিলের খাজা, দানাদার,মটকা ইত্যাদি বিক্রি হতো। আবার চাকভাজা, বারোভাজা, পাপোড় ভাজা, বাদাম, ছোনপাপড়ি, হাওয়ায় মিঠা আড়ংয়ে পাওয়া যেতো। খেলার জন্য রঙীন বেলুন, চুড়ি, মালা, আলতা ফিতা, নানান রকম বাঁশি, মাটির তৈরি রঙ দিয়ে ছোট ছোট হাড়ি পাতিল, কাঁচের বল, লাটিম, চরকা গাড়ি, সাদা দাঁড়ি অলা ঘট বুড়ো,হাতি,ঘোড়া সবই কিনতে পাওয়া যেতো। আড়ংয়ে ঘুরে এসব জিনিষপত্র কিনে, নাগরদোলায় চড়ে তারপর বাড়ি ফিরতাম। মাগুরা, শ্রীপুর, মহম্মদপুর, শালিখার বিভিন্ন গ্রামে আড়ং বসতো। বিশেষ করে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে আড়ং এর আয়োজনটা হতো চমৎকার। মাগুরার গাংনালিয়া, টেঙ্গাখালী, শ্রীপুরের গয়েশপুরের আড়ং এর বেশ নাম ডাক ছিল। মহম্মদপুরের বড়রিয়াতে এখনও জমজমআট আড়ং বসে।
তখনকার দিনের আড়ং এখন নবরুপে সজ্জিত হয়ে “মেলা” নাম নিয়ে প্রকাশিত । কত কি লাইটিং ফাইটিং বিশাল গেট, অন্য রকম ব্যাপার স্যাপার।চুড়ি, ফিতা, আলতার বদলে, আজকাল মেলায় আসবাব পত্র, কাঁচের মেলামাইনের, স্টিলের তৈজসপত্র, ক্রোকারিজ সামগ্রী, কম্বল, রেডিমেড সাফারিসুট, ব্লেজার ইত্যাদি জমজমাট বেচাকেনা হয়ে থাকে। বারোভাজা, চাক ভাজার পরিবর্তে, চটপটি, ফুচকা চেয়ার টেবিলে বসে খেতে পাওয়া যাচ্ছে।
জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে চারপাশের দৃষ্টিভঙ্গি, বস্তু, পরিবেশ, সব পাল্টে যাচ্ছে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। পরিবর্তনশীল এই নিয়মের মধ্যেই জাগতিক জীবন চলতে থাকবে। আমরা যখন অনন্তে পাড়ি জমাবে, তখন মনে হয় আড়ং শব্দটা আমরা সাথে করে নিয়ে যাব, যেমনি ভাবে আমাদের পূর্বসুরিরা অনেক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সাথে করে নিয়ে গেছে।
সুলতানা কাকলি: লেখিকা এবং সাবেক গার্লসগাইড