আয়েশা সিদ্দিকা শেলী : একমাত্র ক্যান্সার আক্রান্ত নারীই জানে তাকে এ পথ কতটা বেদনা নিয়ে অতিক্রম করতে হয়।
ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসা অনেক উন্নত হয়েছে এবং এটি নিরাময়যোগ্য বলা হলেও এটাকে শুধুমাত্র বায়োলজিক্যাল দিক থেকে বিবেচনা করা যায় না। কোন বয়সে ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে, ক্যান্সার কোন স্টেজে আছে, রোগীর পারিবারিক ও আর্থিক অবস্হা, রোগীর স্ট্রেসের সাথে মোকাবিলা করার ধরণ বা কোপিং এবিলিটি, কঠিন সময়ে তার সাপোর্ট সিস্টেম কী, কাছের মানুষগুলোর মনোভাব ইত্যাদি সবকিছুই চিকিৎসা পদ্ধতির উপর প্রভাব ফেলে। তাছাড়া একমাত্র ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই বডি ইমেজ বা নারীর সৌন্দর্য সরাসরি যুক্ত।
এমনিতেই সব ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসার পর কিছু না কিছু দৈহিক পরিবর্তন আসে। কিন্তু ব্রেস্ট ক্যান্সার যেহেতু নারীর সৌন্দর্যে প্রভাব ফেলে তাই অসুখ সংক্রান্ত ভয় এবং মানসিক দ্বন্দ্বের প্রবণতা ও টানাপোড়েন থাকে দ্বিগুন যা অন্যদের অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ক্যান্সার চিকিৎসা কারণে কোন মহিলার চুল পড়ে গেলে বা ব্রেস্ট অপারেশনের মাধ্যমে অপারেশন বা ম্যাসটেক্টমি হলে তার শারীরিক কোন অসুবিধা হয় না কিন্তু তার চুলগুলো যখন বৃষ্টির মত ঝরে পড়ে কিম্বা নিজের অ্ঙ্গহানির ঘটনা ঘটে তখন তার নিজের ভিতরে যে কস্ট আর ভাঙ্গাচোরা শুরু হয় তা শুধু ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারে।
বাইরের মানুষেরা তার বাহ্যিক চেহারা নিয়ে প্রশ্ন করে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে। আর অনেকে করুণার চোখে তাকায়। তার নারীত্ব যেমন প্রশ্নের মুখে পড়ে তেমনি তার নিজেরও মনে হতে পারে তিনি তার নারীত্ব হারিয়েছেন এবং ছোট চুলে তাকে পুরুষের মত লাগছে।
অনেকেই বলেই ফেলে সেই রুপ আর থাকবেনা – চেহারা ভচকাইয়া গেছে। চোখের নীচে কালি, কালো হয়ে যাওয়া, হাত নখ কালো হওয়া সহ অনেক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় শরীরে কেমেথেরাপির পর। যদিও অপারেশনের পর বাহ্যিক চেহারায় বা ত্বকে কোন পরিবর্তন আসে না। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে সমাজের মূলস্রোত থেকে পিছিয়ে পড়ার ভয় কিম্বা স্বামীর সংগে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে এই ভয়ে চিকিৎসা পদ্ধতির উপর নারীরা নেতিবাচক ধারণা-পোষণ করে।
অনেক ক্ষেত্রে রোগীর চিকিৎসা করানোর ইচ্ছা কমে যায়। এই সময় রোগী মানসিক টানাপেড়েনের চরম সীমার মধ্যে অবস্হান করে। এক্ষেত্রে কাছের মানুষ বিশেষ করে স্বামী বা বন্ধু সবচেয়ে বড় নির্ভরতার আশ্রয় হিসাবে থাকতে পারে যা মনের কোণে জমে থাকা এই দ্বিধা বা ভয় কাটাতে সাহায্য করে। তাছাড়া বাবা মা ভাইবোন ছেলে মেয়ে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় পরিজন সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে যা রোগীকে চিকিৎসা নিতে দ্বিধা থেকে বের করে আনবে। যেহেতু ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সাইকোলজির ভুমিকা অন্যান্য ক্যান্সারের চেয়ে অনেক বেশী তাই তার মনোজগতের বিভিন্ন টানাপোড়েন কাজ করে।
পরিবারে ব্রেস্ট ক্যান্সারের পুর্ব ইতিহাস থাকলে তাকে জেনেটিক ব্রেস্ট ক্যান্সার বলে যাদের BRCA1, BRCA2 PH54 পজিটিভ থাকে তাদের জেনেটিক মিউটেশনের কারণে এই রোগ অল্প বয়সেই দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে হলিউডের নায়িকা এন্জেলিনা জোলি একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন ডবল ম্যাস্টেকটমি এবং ওভারেক্টমি করে এবং ব্রেস্ট রিকন্স্ট্রাকশন করার মত সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে। এতে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যান্সার ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্ত আমরা কি পেরেছি? পরিবারে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বডি ইমেজ নস্ট হবার ভয়ে এই সিদ্ধান্ত নেবার কথা চিন্তা করিনি। এবং খুব কম মহিলাই বডি ইমেজ নস্ট করে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
পশ্চিমা নারীদের থেকে মন মানসিকতার দিক থেকে আমরা পিছিয়ে এবং আমরা কম সাহসী। সুস্হ থাকার চেয়ে বডি ইমেজের প্রতি গুরুত্ব অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে আমরা এই কঠিন অসুখ মোকাবিলা করি। তারপরও এই রোগের ফলে শারিরীক পরিবর্তনের কারণে যে মানসিক চাপ এবং চিকিৎসা পরবর্তী কালে পুনরায় রোগীকে সমাজের মুলস্রোতে নিয়ে আসা, তাকে আগের মত গুরুত্ব দেয়া এই সব কিছুর দায়িত্ব থাকে পরিবার এবং কাছের মানুষদের উপর। তাছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভুমিকা অপরিসীম।
অসুখজনিত ভয় দুরে সরে গেলে রোগীর চিকিৎসার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে ফলে তার সুস্হতা ত্বরান্বিত হবে। প্রতিটি ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীকে ভয় না পেয়ে ভাবতে হবে অন্যসব অসুখের মত এটিও একটি অসুখ। অতিরিক্ত চিন্তা বা স্ট্রেস ইমিউনিটিকে প্রভাবিত করে যার ফলে ওষুধ এর কার্যকারিতা কমতে পারে এবং অসুখ সারতে সময় বেশী লাগতে পারে। পরিবার বন্ধু বান্ধব যদি রোগীর ভরসা জোগাতে পারে তবে তার মনোবল বাড়তে পারে এবং এই রোগ এবং চিকিৎসাজনিত জটিলতা দ্রুত সারাতে পারে।
সবচেয়ে সমস্যা হয় কম বয়সে এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে। কমবয়সীদের মধ্যে বডি ডিসফিগারমেন্টের ভয় বেশী থাকে এবং এখানে সন্তান ধারনের বিষয়ও থাকে। বাহ্যিক পরিবর্তন সাময়িক হলেও রোগীর ইমেজে প্রভাব ফেলে এবং অনেক সময় অল্পতেই রেগে যায় কিম্বা ইমোশনাল হয়ে যায়। আত্ম বিশ্বাসের অভাব ঘটলে লোকেরা কী বলল কী ভাবল এটা নিয়ে নারীরা মাথা ঘামায় এবং রিএক্ট করতে থাকে যা তার ব্যক্তিত্বকে দুর্বল করে দেয়। অহেতুক বডি ইমেজ নিয়ে চিন্তা করার কোন মানে নেই।
যাদের ছোট বাচ্চা থাকে তাদের আরেক ভয় কাজ করে সন্তানকে সময় না দিতে পারার ভয়, সন্তানের উপর মানসিক চাপ পড়ার ভয়। সন্তান বড় হলে মানসিক চাপে ভুগবেই কিন্তু ছোট হলে স্বামী কিংবা আত্মীয় পরিজন সময় দিলে এটি পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। অনেকসময় রোগী সন্তানকে বেশী সময় দিতে না পারার কারণে অপরাধবোধ করে এবং সন্তানকে বেশী এটেনশন দিতে শুরু করে যা অনেক সময় সন্তানের ভাবনা চিন্তায় প্রভাব ফেলে।
রোগীকে এটি বোঝানো প্রয়োজন তার সুস্হতা তার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ এবং এই সময় সন্তানের সংগে কোয়ালিটি কাটাতে পারছেন কিনা সেটি নিশ্চিত হলেই হয়। অনেক নারী স্বামীর সংগে কোয়ালিটি টাইম কাটাতে পছন্দ করে কিন্তু সেটি না পেলে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। বেশী বয়সে ব্রেস্টক্যান্সার হলে অনেক নারী ভয়ে চিকিৎসা নিতে চায়না। চিকিৎসা নাহলে তার রোগ আরো বেড়ে যেতে পারে তা রোগীকে পরিবারের সদস্যদের বোঝাতে হবে এবং তিনি যতদিন বেঁচে থাকেন যেন সুস্হভাবে বেঁচে থাকেন।
সাধারণত কোন ব্যক্তি যখন প্রথমবারের মত ক্যান্সার আক্রান্ত হয় তখন সে কোন রিপোর্ট বিশ্বাস করতে চায়না। একাধিক রিপোর্টে যদি একই রেজাল্ট আসে তখন কিন্তু তার মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকেনা। তখন রোগীর মনে একটি প্রশ্নই আসে ‘আমিই কেন? স্রস্টা কি আর কাউকে পেলো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাল জীবনযাপন করি, ব্যায়াম করি, কোক পর্য়ন্ত খাই না তবে কেন এই রোগের শিকার হলাম। চারপাশে যারা অস্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল মেনে চলে তারা দিব্যি ভাল আছে। তখন স্রস্টার উপর ভীষণ রাগ হয়। আাবার অনেকে ঘন ঘন মসজিদ মন্দিরে যায়, দান করে দ্রুত সেরে ওঠার জন্য। আসলে এগুলি অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদি ও কিছুদিন পর অনেকেই বুঝতে পারে তারা সুস্হ হয়ে উঠছেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসছেন। কিন্ত অনেকে মানসিক অবসাদে ভুগতে পারেন যাদের জন্য মানসিক চিকিৎসা দরকার।
একজন মানুষের যখন লাইফ থ্রেট থাকে তখন সে ডিপ্রেশনে যেতেই পারে কিন্তু কেমো চলাকালে অনেকসময় বোঝা যায়না। কারণ ডিপ্রেশনের মত কেমো রোগীর লক্ষণ দ্রুত খিদে, ওজন ও ঘুম কমে যাওয়া। সেক্ষেত্রে অন্যান্য লক্ষণ যেমন নিজেকে গুটিয়ে রাখা, এংজাইটি, হাইপার হয়ে রিএ্যাক্ট করাতে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অধীনে মানসিক চিকিৎসা দিতে হবে। ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীর মনোজগতের টানাপোড়েন চিকিৎসা এবং সুস্হ হওয়ার ক্ষেত্রে দারুনভাবে প্রভাব ফেলে। তাই ডাক্তার এবং প্রিয়জন সবাইকে বোঝাতে হবে চিকিৎসা ঠিকমত হলে স্বাভাবিক জীবন এবং স্বাভাবিক আয়ু পেতে পারে। তার ভয় এবং এংজাইটি কমাতে হলে তার পাশে থাকতে হবে। ভয় বা ডিপ্রেশন যেন তার চিকিৎসা এবং সুস্হতার পথে বাঁধা না হয়। ভালবাসা, যত্ন আর সহানুভূতির মাঝে বেঁচে থাক ব্রেস্ট ক্যান্সার আক্রান্ত নারীরা। কারণ ব্রেস্ট ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য এবং সঠিক চিকিৎসা হলে সুস্হভাবে সমাজ, পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রে তারা সমানভাবে অবদান রাখতে পারে। সকলে সহমর্মী হোন। নারীরা ব্রেস্ট ক্যান্সার থেকে মুক্ত হোক।
আয়েশা সিদ্দিকা শেলী: অতিরিক্ত কর কমিশনার, কর বিভাগ, ঢাকা