অনন্যা হক : এই তো সেদিন সব ছিল। ঝকঝকে সোনাঝরা রোদের সকাল। কত স্বপ্নময়তায় মাখা, কত আনন্দমুখর দিন। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত, আবার রাত থেকে সকাল। কত গতিময়তায় ভরপুর সে জীবন। সারা দিনের কাজের পর আলো পড়ে-আসতো আঁধারে আচ্ছন্ন রাত। যে রাত ছিল বিশ্রামের পর আবার নতুন এক সকাল দেখার অপেক্ষার রাত।
ছন্দময় জীবনের পরতে পরতে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার পাশাপাশি ছিল তবুও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা। আকস্মিক মৃত্যুতে হয়তো আমাদের কোন হাত থাকে না, তবুও সেখানে ছিল না মৃত্যুভয়ে কাঁটা হয়ে থাকার কোন বিভীষিকা। আজ হঠাত্ করে পাল্টে গেল আমাদের জীবনের সব ছন্দ, গতি, তাল ,সুর। যেন থেমে গেল সব স্বপ্ন। এখন জীবনের একটাই মানে-যেন শুধু বেঁচে থাকি, যেভাবেই পারি একটু বেঁচে থাকি।
সব লেনাদেনা স্তম্ভিত। বাহুল্য জীবন, আড়ম্বরপূর্ণ জীবন, চাকচিক্যময় জীবন আজ চাপা পড়ে গিয়েছে বেঁচে থাকার লিপ্সার কাছে। আজ শুধু বেঁচে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে আছি আমরা। এই পৃথিবীর প্রতি কি অসম্ভব মায়া আমাদের! মানুষের প্রতি আমাদের যে অসীম মায়া, জীবনের প্রতি মায়া, আজ সারা পৃথিবীর মানুষ আমরা এক সাথে অনুভব করতে বসেছি।
আমাদের মনের হাজারটা আকুলতা, ব্যাকুলতা, বাহানা আজ ঘরবন্দি। মন বন্দি করে বেঁচে থাকার দিকে তাকিয়ে বসে আছি সকলে মিলে। মাত্র দুই মাস আগেও আমরা ভাবতে পারিনি এই করোনা নামক মহামারির এক হিংস্র থাবা নিয়ে আমাদের সামনে এক ভয়ংকর সময় এমন করে অপেক্ষা করে ছিল।
পথ চলতে চলতে যেন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহার ভেতরে ঢুকে পড়েছি আমরা। এখন এই গুহা থেকে বের হবার পথ খুঁজে চলেছে পুরো পৃথিবীবাসী। হঠাত্ করে আচমকা ঢুকে পড়েছি এক অচেনা পৃথিবীতে। আজ যেন এই মায়াবী আশ্রয় তার মায়ার আঁচলের গিঁট খুলে ফেলেছে।
একদিন যে আশ্রয়, বাসস্থান, খাদ্য, পানি, প্রকৃতির আলো, বায়ু, সৌন্দর্য দিয়ে আগলে রেখেছে পরম মমতায়, আজ সে যেন এক নিষ্ঠুর মূর্তি ধারণ করে আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে। হয়তো শত সহস্র বেদনা, হতাশা, যন্ত্রণা জমে জমে এক পাহাড় সমান ক্ষোভ আর অভিমান জমেছে তার মনে। আমাদের যথেচ্ছার আচরণ, উচ্চভিলাশী জীবনযাপনের এক প্রতিশোধ লিপ্সায় আজ আর কোন দিকে ফিরে তাকানোর সব সদিচ্ছা জলাঞ্জলি দিয়েছে সে।
আজ আমরা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছি পৃথিবীর দিকে, সেই পুরোনো পরিচিত পৃথিবী ফিরে পাবার আশায়। কল্পনার অতীত এক জীবনে ভেতরে বসবাস এখন আমাদের। যার যার সংসারে বন্দি জীবন। স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশীদের সংস্পর্শে আসার প্রতিবন্ধকতা আরোপিত জীবন। এক এক জন যন্ত্রমানবে পরিণত হয়েছি যেন।কাছের কোন আপন জনকে দেখতে চাওয়াটাও যেন সুদূরপরাহত কোন কল্পনা। মায়া, মমতাকে কুক্ষিগত করে স্বার্থপরতার গন্ডি টেনেছি নিজেদের চারিদিকে শুধু একটু বেঁচে থাকার তাগিদে। ভাবিনি কখনও পথ চলতে চলতে পথের কোন এক বাঁকে এমন অবাক বিস্ময়ে স্তম্ভিত সময়ের মুখোমুখি হতে হবে আমাদেরকে।
একদিন মানুষ হিসেবে শিখেছিলাম জীবনের জন্য এক প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ সামাজিকতা ।মানুষ জন্মগত ভাবেই সামাজিক জীব। আজ এই বদলে যাওয়া পৃথিবী বলছে, বেঁচে থাকতে হলে তোমরা অসামাজিক হয়ে থাকো। সামনের দিকে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছিলাম মরিয়া হয়ে সবাই। ছুটছিলাম জীবনকে উন্নত থেকে আরো উন্নত করতে। এক অতি চাকচিক্যময় জীবনের প্রতি তীব্র আকর্ষণে আমরা যখন দিগ্বিদিক হারা ঠিক তেমন একটা সময় বিস্তার লাভ করলো এই বিভীষিকাময় মহামারি।
ঠিক তখনই জীবনের সব বাহুল্য বাহানা ভুলে এক সাদামাটা আকাঙ্ক্ষাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমেছি আমরা। এই সাদামাটা আকাঙ্ক্ষাই আজ বড় মূল্যবান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশ থেকে দেশে, জনপদ থেকে জনপদে, দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেল এই করোনা নামক মহামারি। আমাদের মুখের ভাষা যেন স্তব্ধ, আমরা এখন মন খুলে কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, আমরা প্রাণ ভরে হাসতে ভুলে গিয়েছি।এক বাঁচা মরার আতঙ্ক গ্রাস করেছে আমাদের।
উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছি একটা চকচকে রোদে ভরা স্বর্ণালী সকালের জন্যে, একটা নীরব স্মৃতিময় অলস দুপুরের জন্যে,একটা কোমল রোদের মায়াবী বিকেলের জন্যে, সোনালী আলোয় হেসে ওঠা গোধূলি সন্ধ্যার জন্যে। চাঁদের আলোয় আলোকিত এক নির্মল আঙিনার জন্যে। যেখানে কোন অদৃশ্য বায়বীয় বিষাক্ত জীবাণুর কোন অস্তিত্ব আর কোন দিন যেখানে স্থান পাবে না। আর একটাও প্রাণের করাল গ্রাসে বিসর্জিত হবে না। সর্বপরি এক বিশুদ্ধ পৃথিবীর জন্যে। হেসে উঠুক আবার পৃথিবী, ফিরে আসুক আবার প্রাণচাঞ্চল্য, আমরা আমাদের মনের সব কালিমা, জঞ্জাল, পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে যেতে পারি যেন গতিময়তায় ভরপুর এক জীবনের ভেতরে।শুদ্ধ হোক পৃথিবী,শুদ্ধ হোক আমাদের মন ও জীবন।
সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা– মানুষের আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে এক নতুন পৃথিবী হেসে উঠুক অচিরেই।
অনন্যা হক: লেখিকা ও কবি, প্রাক্তণ শিক্ষার্থি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।