মাগুরা প্রতিদিন ডটকম : ‘আমার ফুটবল জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মাগুরা। কত স্মৃতি! কত কথা! মাগুরা-শ্রীপুরের এমন কোনো মাঠ নেই যেখানে আমি খেলিনি। তারুণ্যের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে আমি ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। এখন বয়স হয়েছে কিন্তু ফুটবলের কোনো স্মৃতিই হৃদয় থেকে মুছে যায়নি। মাগুরার মাঠে-ঘাটে সেই ফুটবল খেলা ভীষণ মিস করি।’ কথাগুলো সাবেক তারকা ফুটবলার সাথী’র।
ফুটবলমোদীদের হৃদয়ে ‘যশোরের সাথী’-নামটি এখনও অক্ষত হয়ে আছে। সত্তর আর আশির দশকে মাগুরায় আয়োজিত কোনো ফুটবল টুর্নামেন্টে সাথী খেলেননি এমন নজির পাওয়া মুশকিল। আসলেই ‘ফুটবলার সাথী’ নামটি উচ্চারিত হলেই মাগুরাবাসীর স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে ফরোয়ার্ড লাইনের সেই দূরন্ত-দুর্বার এক ফুটবলারের কথা। বল নিয়ে যিনি দ্রুতই প্রতিপক্ষের গোল সীমানায় ঢুকে পড়তেন। পুরো শরীরকে শূন্যে তুলে যিনি চমৎকার ভঙ্গীমায় হেড করতেন।
সাবেক এই ফুটবলার যশোরের স্থায়ী বাসিন্দা। শহরের কারবালাতে বাসা। সাবেক এই ফুটবলারের কাছ থেকে জানা যায়, মাগুরাতে তিনি প্রথম খেলতে আসেন সম্ভবত ৭৭ সালে আন্তস্কুল প্রতিযোগিতার ফাইনাল ম্যাচে। সেই ম্যাচ হয়েছিল মাগুরা কোর্ট মাঠে। যশোরের মিউনিসিপ্যালিটি প্রিপারেটরি স্কুলের সাথে প্রতিপক্ষ ছিল মাগুরা একাডেমি স্কুল। কণ্ঠশিল্পী মণি কিশোর (মণি মন্ডল) তখন মাগুরা একাডেমি স্কুল দলের গোলকীপার ছিলেন।
সাথী জানান, এর কিছুদিন পর শফিকুজ্জামানসহ যশোরের বড় ভাইদের সাথে তিনি বন্ধু কালামকে নিয়ে মাগুরাতে যান একটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে। সে ম্যাচ হয় নোমানী ময়দানে। এসময় তাঁর সাথে ফুটবলার মোহন, বড় মোহন, লোভন, মকবুল এমন অনেকের সাথে পরিচয় হয়। এরপর ফুটবলার লোভন তাঁকে প্রথম মাগুরা ইয়থ ক্লাবে খেলার জন্যে হায়ার করেন। শুরু হয় মাগুরার মাঠে তাঁর পদচারণা। এরপর প্রায় সব টুর্নামেন্টেই কোনো না কোনো ক্লাবের পক্ষে তিনি অংশ নিতে থাকেন। ‘যশোরের সাথী’ নামটিও ট্রেডমার্ক হয়ে উঠে।
স্কুলের শিক্ষার্থী থাকার সময় থেকেই ফুটবল মাঠে রঙ ছড়ানো শুরু করেন সাথী। ৭৬ সালে সে সময়কার বৃহত্তর যশোর জেলা একাদশের মূল দলে ঠাঁই পান। সে বছর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত শেরেবাংলা কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় যশোর জেলা একাদশ। দলের কণিষ্ঠ সদস্য হিসেবে শফিকুজ্জামান, আব্দুল হাকিম, গাজী ওয়াজেদ, সৈয়দ নাজমুল হাসান লোভন, জিল্লুর কাওসার, রকিব, কাজী ফিরোজদের সাথে তিনিও খেলার সুযোগ পান। ৭৮ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অভিষেক হয় তাঁর সে সময়কার অন্যতম প্রধান আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব দিয়ে। ১৯৭৯ সালে আবাহনীতে অতিথি খেলোয়াড় হিসেবে আগা খান গোল্ডকাপে অংশ নেন তিনি। ফুটবলের রাজপুত্র কাজী সালাহউদ্দিন, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, গোলাম রাব্বানি হেলালদের পাশে খেলে সাথীর ফুটবল জীবন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বার্মার সাথে করা একটি গোল ফুটবল জীবনের খাতায় নতুন এক অধ্যায়েরও সূচনা করে। দু বছর পরেই যোগ দেন অন্যতম সেরা বিজেএমসি ক্লাবে (৮১-৮২)। বিজেএমসিতে তখন সেরা লাইনআপ-হেলাল, আসলাম, বাসু, গোবিন্দ, লোভন, আমিন, আনোয়ার, বড় বাদল, মুকুল, কাওসার, রকিবসহ আরও অনেকেই। বিজেএমসির পর সাধারণ বীমা এবং ভিক্টোরিয়াতে খেলেন। কিন্তু একটি সড়ক দুর্ঘটনা সাথীর ফুটবল জীবনকে লন্ডভন্ড করে দেয়। ৮৬ সালে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ছেড়ে ব্রাদার্স ক্লাবে যোগ দেওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি নেন। এর মধ্যে যশোর নিজ বাড়িতে আসেন। মে মাসের দিকে যশোরের বন্ধু ফুটবলার আকতারের ছোট ভাই-এর বিয়েতে ঝিনাইদহ যাওয়ার পথে নিজেদের প্রাইভেট কার দুর্ঘটনায় পড়লে তাঁর দুই হাতই ভেঙে যায়। দীর্ঘদিন এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে মাঠরে বাইরে থাকেন। এরপর অনেকদিন ধরে চিকিৎসা চলে। ১৯৮৮ সালে আবার ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ফিরে আসেন। আরামবাগ ক্লাবের হয়ে ফেডারেশন কাপে মাঠে নামেন। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। আবারও আঘাতপ্রাপ্ত পান। অতঃপর ডাক্তাররে পরামর্শে চোখের জলে তাঁকে ফুটবল থেকে চিরবিদায় নিতে হয়। আকাশ থেকে ঝরে পরে এক ফুটবল নক্ষত্র।
এখনও ফুটবল ভীষণ ভালোবাসেন সাথী। চেষ্টা করেন নতুন প্রজন্মকে ফুটবলের প্রতি আগ্রহী করতে। দেশের ফুটবল সেই আগের রং-রূপ হারিয়ে ফেলায় অনেকের মতো সাবেক ফুটবলার সাথীও মনোকষ্ট পান। নিজেকেই প্রশ্ন করেন কবে ফিরবে সেই প্রাণময় ফুটবল?