মাগুরা প্রতিদিন ডটকম : মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার তাঁরাউজিয়াল (মুন্সিপাড়া) গ্রামের কৃতি সন্তান দেশের খ্যাতনামা কৃষি বিজ্ঞানী ড. মোঃ আমিরুজ্জামান বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন। দেশের জ্যেষ্ঠ ভুট্টা প্রজননবিদদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
২৯ জুন ২০২১ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশ বলে “বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট” (বাগভুগই), দিনাজপুর এ যোগদান করেন। ২০১৭ সালে ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর তিনি ৪র্থ মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করলেন।
বর্তমান পদে যোগদানের পূর্বে অত্র প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর উইং এ পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ড. মোঃ আমিরুজ্জামান ১৯৬২ সালে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার তারাউজিয়াল গ্রামের মুন্সিপাড়ায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শ্রীপুরের আমতৈল হাইস্কুল থেকে ১৯৭৮ সালে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি এবং ১৯৮০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোন। তিনি মাগুরার সাংবাদিক তাছিন জামানের চাচা।
ড. আমিরুজ্জামান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সালনা, গাজীপুর থেকে জেনেটিক্স এন্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিষয়ে কৃষিতে মাস্টার্স এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ থেকে “গুণগত প্রোটিন সমৃদ্ধ হাইব্রিড ভুট্টা উদ্ভাবন” এর উপর গবেষণা করে জেনেটিক্স এন্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। দেশী ও বিদেশী স্বনামধন্য বিভিন্ন জার্নালে তার ৫০টির অধিক গবেষণা প্রকাশনা রয়েছে। তিনি বিভিন্ন দেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কসপে অংশ নেন। ড. জামানের স্বপ্ন হলো জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত বিভিন্ন প্রতিকূলতা সহনীয় উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ভুট্টা ও গমের জাত উদ্ভাবনে এবং দেশের চাহিদানুযায়ী দেশেই ভুট্টার হাইব্রিড ও গমের প্রজনন বীজ উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা, যাতে কৃষকেরা কম মূল্যে দেশে উৎপাদিত ভুট্টা ও গমের বীজ ক্রয় ও আবাদ করে লাভবান হোন এবং দেশের প্রতিকূল এলাকায় এদের আবাদ সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
বর্তমান পদে যোগদানের আগে তিনি দেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান “বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট” (বারি) এর প্রধান কার্যালয় জয়দেবপুর, গাজীপুরে উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন ভুট্টাসহ, বার্লি, চীনা, কাউন, সরগম, ওট, রাঘী প্রভৃতি অপ্রচলিত দানাদার ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন গবেষণা কার্যক্রমের নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং এসব ফসলের নতুন উদ্ভাবিত জাতসমূহ সারা দেশব্যাপী কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
তিনি ১৯৮৯ সালে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (প্লান্ট ব্রিডিং) হিসেবে বারি-তে যোগদান করেন। জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় বারি-তে উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
জানা গেছে, বারিতে সুদীর্ঘ প্রায় ৩২ বছর চাকুরী জীবনে তিনি ভুট্টা, যব (বার্লি), সরগম, কাউন, ওট প্রভৃতি ফসলের ২৮টি উচ্চ ফলনশীল উন্নত জাত উদ্ভাবনের গবেষণার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন, যার মধ্যে অনেকগুলোতে তিনি প্রধান গবেষক হিসেবে নেতৃত্ব দেন। এসব ফসলের উদ্ভাবিত উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতসমূহ চাষ করে কৃষকেরা অধিক ফলন পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন এবং দেশের খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করছে।
দেশে হাইব্রিড ভুট্টার জাত উদ্ভাবনের গবেষণায় তিনিই প্রথম প্রচলিত ধারার পরিবর্তে নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটান। হাইব্রিড ভুট্টার জাত উদ্ভাবনে ইনব্রিড লাইন বা প্যারেন্ট লাইনের গুরুত্ব অপরিসীম, যেগুলো মূলত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকেই পাওয়া যেত। কিন্তু উক্ত প্যারেন্ট লাইনসমূহ ব্যবহার করে তৈরী হাইব্রিড ভুট্টা দেশের ও কৃষকের চাহিদা পূরণে সুবিধা করতে পারছিল না। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তিনি দেশেই ভুট্টার প্যারেন্ট লাইন তৈরীর মত কষ্টকর ও সময় সাপেক্ষ গবেষণা কাজ হাতে নিয়ে প্রথম শুরু করেন। উল্লেখ্য যে, প্যারেন্ট লাইন তৈরিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে সর্বোচ্চ সতর্কতা, সততা ও একনিষ্টভাবে প্রায় ৬-৭ বছর কাজ করতে হয়। এই নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী উন্নত মানের প্যারেন্ট লাইন তৈরির মাধ্যমে দেশের ও কৃষকদের চাহিদানুযায়ী উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ভুট্টার জাত উদ্ভাবনের গবেষণা কাজের তিনিই পথিকৃত। এভাবে গবেষণার মাধ্যমে তাঁর উদ্ভাবিত ইনব্রিড লাইন ব্যবহার করে তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বারি) থাকাকালীন প্রধান গবেষক হিসেবে ভুট্টার ৩টি উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড এবং নবসৃষ্ট বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আরও ২টি উন্নত উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করেছেন।
জানা যায়, উদ্ভাবিত এসব জাতের মধ্যে ২টি খরা সহনশীল (বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩, যা একটিমাত্র সেচ প্রয়োগে উৎপাদন সম্ভব); ১টি খাটো আকৃতির ও হেলে পড়া সহনশীল (ডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড ভুট্টা-১); ১টি খাটো ও লবণাক্ততা সহনশীল (বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬) এবং ১টি দেশে উদ্ভাবিত প্রথম উচ্চ মূল্যের ফসল বেবী কর্ণের হাইব্রিড (ডাব্লিউএমআরআই হাইব্রিড বেবী কর্ণ-১) রয়েছে। বেবী কর্ণ স্বল্প মেয়াদী ফসল হওয়ায় এটি আবাদ ও বিক্রির মাধ্যমে কৃষকরা যেমন লাভবান হতে পারবেন, তেমনি এটি প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানীর মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। এছাড়া বেবী কর্ণ সংগ্রহের পর সবুজ গাছ ও পাতা উৎকৃষ্ট গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। উন্নত দেশগুলোতে বেবী কর্ণ একটি উপাদেয় সব্জি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান প্রভৃতি দেশ সারা বিশ্বে প্রক্রিয়াজাতকৃত বেবী কর্ণ রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে যা আমাদের দেশেও সম্ভব।
বাংলাদেশে আবাদকৃত বেশিরভাগ হাইব্রিড ভুট্টার বীজ বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়, ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। ড. জামানের উদ্ভাবিত জাতের ভুট্টার হাইব্রিড বীজ বর্তমানে দেশেই তৈরী হচ্ছে। এতে করে দেশে বীজ শিল্প গড়ে ওঠবে এবং এর মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তার উদ্ভাবিত খাটো আকৃতির ঝড়-বাতাস সহনশীল ও মধ্যম মাত্রার লবণাক্ততা সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল জাত বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬ এর হাইব্রিড বীজ দেশেই উৎপাদন করে স্বল্পমূল্যে কৃষকদের কাছে বিক্রি করছে বিএডিসি। এতে করে কৃষকেরা উপকৃত হচ্ছেন। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় তাঁর উদ্ভাবিত মূল্যবান প্যারেন্ট লাইনগুলো বিভিন্ন প্রতিকূলতা সহনশীল নতুন নতুন হাইব্রিড ভুট্টার জাত উদ্ভাবনের গবেষণায় বহুল ব্যবহার হচ্ছে।
ড. জামানের গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটে মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান দিনাজপুরে এ নবীন প্রতিষ্ঠানের গম ও ভুট্টার নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের গবেষণা, বীজ উৎপাদন ও সম্প্রসারণ কাজে গতি বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা যায়। মাগুরাসহ অত্র অঞ্চলে এবং সাথে সাথে সারা দেশের কৃষকেরাও নতুন উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাত আবাদ করে লাভবান হবেন এবং দেশে গম ও ভুট্টার আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ধানের পরেই গম ও ভুট্টা দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকার এ দুটি দানাদার ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়েছে, বিশেষ করে সারা দেশে ভুট্টার আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির উপর বর্তমান কৃষি মন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
বাংলাদেশে ভুট্টা বর্তমানে কৃষকদের কাছে একটি ঝুকিমুক্ত ও লাভজনক অর্থকরী দানাদার ফসল। দেশে ক্রমবর্ধমান পোল্ট্রি শিল্প, মাছ ও গবাদি পশুর খাবার হিসেবে উৎপাদিত সিংহ ভাগ ভুট্টা ব্যবহৃত হচ্ছে। দিন দিন ভুট্টার আবাদ ও উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে। এ উৎপাদন ধারা বজায় রাখতে দরকার লাগসই প্রযুক্তি সহ উচ্চ ফলনশীল নতুন নতুন জাত, যা আবাদ করে উপযুক্ত ফলন পেয়ে কৃষকেরা লাভবান হবেন। আশা করা যায় দিনাজপুরের এ প্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট এই বিজ্ঞানীর মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান গবেষণা, বীজ উৎপাদন ও সম্প্রসারণ কাজে গতি বৃদ্ধি পাবে।