মাগুরা প্রতিদিন ডটকম : মাগুরায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধিত বেশকিছু এনজিওর নামে একটি সিণ্ডিকেট সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সহায়তায় অনুদানের অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছে। গত দুই বছরে জেলার ৭টিসহ আরো কিছু এনজিওর নামে কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাথ করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, মাগুরা ও পাশ্বাবর্তি জেলা ঝিনাইদহের একটি চক্র মাগুরা সমাজকল্যাণ সংসদ, সৃষ্টি ফাউণ্ডেশন, রাজলক্ষ্মী কল্যাণ ফাউণ্ডেশন, আলোর ঠিকানা ফাউণ্ডেশন, ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট ফাউণ্ডেশন, রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফাউণ্ডেশন, মাগুরা জেলা মানবাধিকার সংস্থাসহ আরো বেশ কিছু সংস্থার নামে বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থ উত্তোলন করে এই চক্রটি আত্মসাথ করে আসছে। যে কার্যক্রমটির শুরু ২০১৮ সালের জুন মাসে।
তথ্যমতে, চক্রটি প্রথমে মাগুরা জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সহায়তায় নিবন্ধিত বিভিন্ন এনজির জমাকৃত কাগজপত্র সংগ্রহ করে। পরে ওই বছরের ২৪ ও ২৬ জুন তারিখে ওইসব এনজি’ওর নামে ঝিনাইদহে সোনালী ব্যাংকের আরাপপুর শাখায় পৃথক পৃথক একাউন্ট তৈরি করা হয়।
জালিয়াতির দ্বিতীয় ধাপে সিণ্ডিকেটটি এসব এনজিওর নামে তৈরি করে সিল প্যাড। সেখানে নিজেদের নাম-মোবাইল নম্বর যুক্ত করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিন জেলায় পরিচালিত সিভিল সার্জন কার্যালয় এবং পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে অনুদানের জন্যে আবেদন করে। পরিকল্পনা চুড়ান্ত করতে চক্রটি ঢাকায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় নিজেদের অনুকুলে বিভিন্ন অংকের অর্থও ছাড় করিয়ে আনে। পরবর্তিতে জেলা কর্মকর্তাদের খুশি করিয়ে ভূয়া বিল ভাওচারে প্রতিস্বাক্ষর নিতে সক্ষম হয় তারা। সবশেষে ঝিনাইদহে আগেই খুলে রাখা একাউন্টে চেক জমা এবং অর্থ আত্মসাথ পর্ব।
বিগত সময়ে মাগুরা পরিবার পরিকল্পনা এবং সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে উল্লেখিত ৭টি এনজিওর নামে জমাকৃত ব্যাংক স্টেটমেন্ট থেকে দেখা যায় চক্রটির নিয়ন্ত্রণাধিন ঝিনাইদহ সোনালী ব্যাংকের ওইসব ভুয়া একাউন্ট থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত সর্ব সাকূল্যে ৯২ লক্ষ ৭৭ হাজার ৭৫৭ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাগুরা সমাজ কল্যাণ সংসদের বর্তমান সভাপতি জেলা যুবলীগ আহ্বায়ক ফজলুর রহমান। তার নামে চলতি বছরের ৪ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধিন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব বরাবর অনুদানের জন্যে একটি আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে নিলুফার ইয়াসমিন নামে ঝিনাইদহের একটি মেয়ের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। রাজলক্ষ্মী কল্যাণ ফাউণ্ডেশন মাগুরা শহরের পারলা এলাকার বাসিন্দা আওয়ামীলীগ কর্মী এবিএম মোস্তাফিজুর রহমান আকিনুরের। কিন্তু নিলুফার ইয়াসমিন নিজেকে নির্বাহী পরিচালক পরিচয় দিয়ে সেটির আবেদন করেছেন। শহরের সৃষ্টি ফাউণ্ডেশনের পরিচালক অলোক বসু। তার আবেদন পত্রে নামের নীচে মাহমুদ হাসান টিপু নামে ঝিনাইদহে কর্মরত একজন সাংবাদিকের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। মাগুরা জেলা মানবাধিকার সংস্থার পরিচালক বাহারুল ইসলাম হলেও সেখানে জাহিদ সুলতান নামে ঝিনাইদহের অপর এক ব্যক্তি নিজের নাম মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেছেন। আলোর ঠিকানা ফাউণ্ডেশনের পরিচালক আলমগির শেখ। এই নামটি ঠিক রেখে মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। শহরের কলেজপাড়ার ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট ফাউণ্ডেশন ও রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফাউণ্ডেশনের নামে ভিন্ন দুটি নম্বর যুক্ত করে অনুদানের জন্যে আবেদন করা হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, ঝিনাইদহের কথিত এনজিও কর্মী জাহিদ সুলতান শাওন, মাহমুদ হাসান টিপু, নিলুফর ইয়াসমিনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিণ্ডিকেটটি গত দুই বছরে উল্লেখিত ৭টি ছাড়াও আরো কিছু এনজিওর পরিচালকের নাম মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে কোটি টাকার বেশি মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় করিয়ে আত্মসাথ করেছে।
জালিয়াতির শিকার মাগুরার এনজিও কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে কিছুই জানা নেই বলে তারা জানিয়েছেন। মাগুরা সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি যুবলীগ নেতা ফজলুর রহমান বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নিজস্ব অর্থায়নে আমরা মানুষকে সেবা দিয়ে আসছি। সরকারি সাহায্যের জন্যে অতিতে কখনোই আবেদন করিনি। এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই আইনের আশ্রয় নেয়া হবে।
অন্যদিকে রাজল²ী কল্যাণ ফাউণ্ডেশনের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান আকিনুর বলেন, জাহিদ সুলতান শাওন নামে এক ব্যক্তি বরাদ্দ এনে দেয়ার কথা বলে ৩ হাজার টাকা দাবি করেছিলো। রাজি না হওয়ায় সে পরবর্তিতে যোগাযোগ করেনি। তারপরও এতবড় জালিয়াতির ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত না থাকলে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।
অভিযুক্ত সিণ্ডিকেট সদস্য নিলুফর ইয়াসমিনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিচয় শুনেই ফোন কেটে দেন। তবে মাহমুদ হাসান টিপু বলেন, এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। শাওন কিংবা নিলুফর ওরাও ভালো মানুষ। অসহায় মানুষের লেখাপড়ার খরচ যোগাড়ের উদ্দেশ্যে নিষ্ক্রিয় এনজিওদের কাগজপত্র নিয়ে তারা কাজ করে থাকে। আর সৃষ্টি ফাউণ্ডেশনের পরিচালক অলোকের সঙ্গে সুসম্পর্কের খাতিরে তার সঙ্গে শাওনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম মাত্র। কিন্তু ওরা কেনো সেখানে আমার মোবাইল নম্বর যুক্ত করেছে সেটি জানিনা। তবে মাগুরার এনজিওর নামে ঝিনাইদহের ব্যাংকে একাউন্ট তৈরি করা ওদের ঠিক হয়নি।
মাগুরা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নিরঞ্জন বন্ধু দাম বলেন, অতীতে কারা কী করেছে সেটি নিয়ে কিছু করার নেই। কেননা সেগুলো মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন করা হয়েছিল। তারা কার নামে কী দিয়েছে সেটি তারাই বুঝবে। কিন্তু এখন প্রতিটি আবেদন পত্র যাচাই বাছাই করেই তালিকা প্রেরণ করা হচ্ছে। এখানে জালিয়াতির কোনো সুযোগ থাকবে না। অন্যদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি অর্থ উত্তেলন করেছে কিনা সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন মাগুরার সিভিল সার্জন ডা. প্রদীপ কুমার সাহা।