কাসেমুর রহমান শ্রাবণ : মাগুরায় ২০২০ সালে হত্যাকাণ্ডসহ ২৮৬টি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৭টি হত্যাকাণ্ড। বাকি ২৫৯টি অস্বাভাবিক মৃত্যু। পাশাপাশি ঘটেছে ৭৩টি ধর্ষণের ঘটনা। মাগুরা প্রতিদিনের বাত্সরিক পর্যালোচনায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। তবে জেলায় সংঘটিত ২৭ টি হত্যাকান্ডের মধ্যে ১৫ টির তদন্ত কাজ শেষ হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে সংশ্লিষ্ট মামলা।
তথ্যমতে, জেলায় ২৭টি হত্যাকান্ডের মধ্যে মাগুরা সদরে সর্বাধিক ১২টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর পরেই রয়েছে মহম্মদপুর উপজেলা। যেখানে ঘটেছে ৮ টি হত্যাকান্ড। ৩য় অবস্থানে রয়েছে শ্রীপুর উপজেলা। এ উপজেলায় ঘটেছে ৪ টি হত্যাকান্ড। এছাড়া শালিখা উপজেলায় ঘটেছে সবথেকে কম ৩ টি হত্যাকান্ড।
মাগুরা সদরের মধ্যে উল্লেকযোগ্য হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে সদর উপজেলার হাজরাপুর ইউনিয়নে। যেখানে নভেম্বর মাসে ১৫ দিনের ব্যবধানে খুন হয় দুইজন। ওই ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যান এর সামাজিক বিরোধ এর কারণে জাকির হোসেন লিটন ও মাছুদ মোল্লা নামে দুই গ্রুপের দুজন হত্যাকান্ডের শিকার হন বলে এলাকাবাসি জানান।
১ নভেম্বর ২০২০ সালের রবিবার। এদিন হাজরাপুর ইউনিয়ের ছাচানী গ্রামে মাছুদ মোল্লাকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষরা। হাজরাপুর ইউনিয়নের এক নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক বারিক মোল্লা ও একই ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বর আবু কালামের মধ্যে সামাজিক রিরোধের জের ধরে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। নিহত মাছুদ মোল্লা বারিক মোল্লার সমর্থক।
একই মাসের ১৬ তারিখ সোমবার রাতে নন্দলালপুর গ্রামে আধিপত্য বিস্তার ও সামাজিক দলাদলি নিয়ে প্রতিপক্ষ শরিফুল মোল্যার লোকজন কুপিয়ে হত্যা করে জাকির হোসেন লিটনকে। ওই ইউনিয়নে অধিকাংশ গ্রামে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বর্তমান সদর উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান এবং ওই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান জেলা যুবলীগ নেতা কবির হোসেনের সর্মথকদের পৃথক দুটি সামাজিক গ্রুপ বিদ্যমান রয়েছে।
দুটি খুনের জের ধরে নন্দলালপুর ও সাচানি গ্রামে চলে বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট এর ঘটনা। যে ঘটনায় দুই গ্রামের প্রায় অর্ধশত জনকে আসামী করে থানায় মামলা হয়। এদিকে এ ঘটনায় প্রশাসনিক কঠোর হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক সমজোতায় দ্রুত এই গ্রামীণ জনপদের সামাজিক দলাদলি এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দির্ঘদিন চলে আসা সংঘর্ষ, হত্যা, হামলা, বাড়িঘর ভাংচুর লুটপাট বন্ধ করে শান্তিপূর্ন বসবাসের নিশ্চয়তা চায় সাধারণ মানুষ।
এছাড়া জেলা সদরে আলোচিত হত্যাকান্ড ছিলো ৭ বছরের শিশু মাহিদ হত্যাকান্ড। পারিবারিক পূর্ব বিরোধের জের ধরে মাগুরা সদর উপজেলার বারাশিয়া গ্রামে মাহিদ হোসেন (৭) নামে এক শিশুকে নবগঙ্গা নদীতে তালের ডোঙায় বেঁধে ডুবিয়ে হত্যা করে প্রতিবেশি কিশোর রোহান মোল্যা। ঘটনাটি ছিলো এমন তিন বছর আগে পারিবারিক একটি বিষয় নিয়ে চাচাতো ভাই আসলাম মোল্লার সঙ্গে বিরোধ হয় মাহিদের বাবা মুজিবুর রহমানের।
সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে আসলাম মোল্লা ও তার ছেলে রোহান পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ০৭ অক্টোবর বুধবার সকালে মাহিদকে স্থানীয় নবগঙ্গা নদীতে নিয়ে যান। সেখানে একটি তালের ডোঙ্গার সঙ্গে হাত বাঁধা অবস্থায় মাহিদকে ডুবিয়ে দেন তারা। মাহিদকে খুঁজে না পেয়ে ওই দিন রাতে মাগুরা সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন মুজিবুর রহমান। পরদিন মাহিদের নানা দুলাল হোসেনের কাছে মোবাইল ফোনে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
বিষয়টি পুলিশকে জানালে মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে রোহানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় হত্যার দায় স্বীকার করে রোহান পুলিশের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেন। নবগঙ্গা নদীতে দমকল বাহিনীর ডুবুরিদের মাধ্যমে দুই দিন তল্লাশির পর রোববার দুপুর ২টায় মাহিদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত মাহিদের বাবা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। মামলা দায়েরের পর আসলাম মোল্লা ও তার ছেলে রোহান মোল্যাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এদিকে জেলার শ্রীপুর উপজেলার ৪ টি হত্যাকান্ডের মধ্যে উল্যেখযোগ্য ছিলো ৫০০ টাকার জন্য এক সুদে কারবারির হত্যা। ১৪ অক্টোবর বুধবার মনিরুল মীর (৪৫) নামে এক সুদে কারবারিকে হত্যা করা হয়। এছাড়া ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দ্বারিয়াপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পেছনে ধান ক্ষেতের মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় লাশটি পড়ে থাকতে দেখে থানায় খবর দিলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশটি উদ্ধার করে। এছাড়া ৩ এপ্রিল শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চরমহেশপুর গ্রামের বাড়ির কলপাড়ের পাশ থেকে পিকুল বিশ্বাস (৩৬) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরকিয়া প্রেমের জেরে ওই গ্রামের রাজিয়া সুলতানা ও তার প্রবাসী স্বামী কাজী মোশারোফ হোসেন তাকে পিকুলকে বাড়িতে ডেকে দুধের সাথে একাধিক ঘুমের বড়ি মিশিয়ে খাওয়ানোর পর অচেতন হয়ে পড়লে তার গলা কেটে হত্যা করে বাড়ির পাশের কলপাড়ে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দিয়ে দেন। এ ঘটনায় ওই স্বামী স্ত্রীকে আটক করে পুলিশ।
এছাড়া শালিখা উপজেলাতে কম সংখক ৩ টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। যেখানে উল্যেখযোগ্য ছিলো নিখোঁজের ২ দিন পর পুকুর থেকে হাজী ইউনুস (৬৫) নামে এক ব্যবসায়ীর মরদেহ উদ্ধার। ঘটনাটি ঘটে ১৫ নভেম্বর রবিবার বিকালে। এলাকাবাসি রবিবার বিকাল ৩টার দিকে কুশখালী গ্রামের একটি পুকুরে হাজী ইউনুসের মরদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দিলে শালিখা পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে। সেসময় স্থানীয় তালখড়ি ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান এর বরাত দিয়ে জানাযায়, দীর্ঘদিন ধরে কুশখালী গ্রামের গ্রাম্য মাতবর শাখাওয়াত হোসেন ও গোলাম সরোয়ারের নেতৃত্বে দু’দল গ্রামবাসীর মধ্যে বিরোধ চলে আসছিলো। এ বিরোধের জের ধরে স্থানীয় একটি হত্যা মামলার সাক্ষ্য দেয়ার কারণে এক সপ্তাহ আগে প্রতিপক্ষ গোলাম সরোয়ারের সমর্থকেরা সাখাওয়াত হোসেনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালায়।
এ ঘটনার জের ধরে গত শুক্রবার দুপুরে দুই পক্ষের মধ্যে নতুন করে বাকবিতণ্ডা ও উত্তেজনা হয়। এরই একপর্যায়ে শুক্রবার রাতে নিখোঁজ হন হাজী ইউনুস। অন্যদিকে রবিবার বিকাল ৩টার দিকে কুশখালী গ্রামের একটি পুকুরে এলাকাবাসী হাজী ইউনুসের মরদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দিলে শালিখা পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে। এদিকে জেলায় সবশেষ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় মহম্মদপুর উপজেলার বাবুখালি ইউনিয়নে। যেখানে যৌতুকের জন্য কাঠ দিয়ে পিটিয়ে মনিরা খাতুন (১৮) নামে এক গৃহবধুকে হত্যা করে তার স্বামী জিয়ারুল মুন্সি। ২৫ ডিসেম্বর শুক্রবার রাতে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মহম্মদপুর থানায় স্বামীসহ ৫ জনকে আসামি করে মামলা করে নিহত গৃহবধুর বাবা আরিফ মোল্যা । রবিবার রাতে আটক করা হয় ঘাতক স্বামী জিয়ারুর মুন্সিকে। এছাড়া এই উপজেলায় আলোচিত হত্যাকান্ড ছিলো আবু সাঈদ মোল্লা (৬০) নামে এক অবসারপ্রাপ্ত এক পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা। ১৩ জানুয়ারি সোমবার রাতে উপজেলার বালিদিয়া গ্রামে ঘোড়দৌড় মেলা থেকে ফেরার পথে রাত ৮টার দিকে বালিদিয়া মধ্যপাড়া নওশের শিকদারের বাড়ির সামনে পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে জখম করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
ঘটনাসৃত্রে জানাযায় দীর্ঘদিন ধরে বলিদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান ও একই গ্রামের নূরুল ইসলাম মৃধার নেতৃত্বে দুই দল গ্রামবাসীর মধ্যে সামাজিক বিরোধ চলে আসছে। যা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একাধিকবার সংঘাত, সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে। আর ওই ঘটনার জের ধরেই প্রতিপক্ষ মফিজুর রহমান গ্রুপের লোকজন আবু সাঈদ মোল্লার ওপর এ হামলা চালায় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে পুলিশ। নূরুল ইসলাম মৃধার দলভুক্ত ছিলেন আবু সাঈদ। উপজেলার ওই ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান দুজন চেয়ারম্যানই হত্যা মামলার আসামি।
ধর্ষণ এর মধ্যে উল্যেখযোগ্য ছিলো ২২ নভেম্বর শনিবারের ঘটনা। সে রাতে মাগুরা সদর উপজেলার জাগলা গ্রামে স্বামীকে গাছের সাথে বেধেঁ স্ত্রীকে গণধষর্ণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পরদিন রবিবার মাগুরা সদর থানায় মামলা করে ধর্ষনের স্বীকার পঞ্চাশ বছর বয়সী ওই মহিলা। মামলার বিবরনিতে তারা জানান, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বন্দেখালি গ্রাম থেকে ঘটনার প্রায় ২০ দিন পূর্বে মাগুরা সদরের জাগলা গ্রামে আসে তারা। দিনমজুর হিসেবে তারা স্বামী স্ত্রী অন্যের জমিতে ধান সংগ্রহের কাজ কর ছিল। তারা স্বামী স্ত্রী জাগলা মাঠেই তাবু খাটিয়ে বসবাস কর ছিল।
শনিবার রাত আনুমানিক সাড়ে ৭টার দিকে ৫ জনের একটি সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারী তার গলায় অস্ত্র ঠেকিয়ে একটি গাছের সাথে বেধেঁ রাখে এবং তার স্ত্রীকে জোর করে ধরে পার্শ্ববর্তী একটি পুকুরের নিকট নিয়ে ধর্ষন করে । ধর্ষন শেষে কাউকে কিছ বললে প্রাণে মারার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে । পরে তাদের ডাক চিত্কারে এলাকার লোকজন উদ্ধার করে । এ সময় তার কাছে থাকা ৫ হাজার টাকাও তারা ছিনিয়ে নেয়।
এদিকে জেলায় ২৫৯ টি অপমৃত্যুর ঘটনার মধ্যে ঘটনা বহুল ছিলো জেলার মহম্মদপুরে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১ জানুয়ারি বুধবার দুই ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা। উপজেলার হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের জিয়া রহমান মোল্যার মেয়ে সুমাইয়া খাতুন (১৩)। এছাড়া জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করে একই উপজেলার খলিশাখালী গ্রামের গোলাম রব্বানীর মেয়ে নাজমা আক্তার (১৩)। তাছাড়া জেল সদরে বিয়ের তিন মাস পরে যৌতুকের বলি হতে হয় জান্নাতুল ফেরদৌস তমা (১৮) নামের এক গৃহবধু। ১৭ ডিসেম্বর সকালে সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের টিপু মোল্যার বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তমার স্বামী নাঈম একটি মোটর সাইকেল দাবি করেছিলো । যেটি দিতে দেরি হওয়াই তাকে হত্যা করা হয় বলে জানান নিহত তমার বাবা রাশেদুল ইসলাম । যে ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়।
জেলায় সংঘটিত ২৭ টি হত্যাকান্ডের মধ্যে ১৫ টি মামলার তদন্ত শেষে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া ১২ টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে বলে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।