সুলতানা কাকলি : আমাদের বরেন্দ্রভূমি এই বাংলার জনপদের মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা বাঁশ, বেত প্রাচীন শিল্প, সংস্কৃতি লোক চক্ষুর অন্তরালে একটু একটু করে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও প্লাস্টিক দ্রবাদির দাপটে মাগুরা থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন এই বাঁশ, বেত শিল্প সংস্কৃতি এবং এর সাথে জড়িয়ে থাকা কারিগররা।
বর্তমানে মাগুরা শহরের যে সড়কটি পিটি আই সড়ক নামে পরিচিত, ওই সড়কটি ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই এখনও কয়েক ঘর নিম্ন বর্ণের মানুষদের বসবাস দেখতে পাওয়া যায়। ওই এলাকাটা ঋষিপাড়া বা স্থানীয় ভাষায় মুচিপাড়া বলা হয়ে থাকে। আশির দশকেও ওই পাড়াতে অনেক ঘরের বসতি ছিলো। এবং ওদের কোলাহলে মুখরিত ছিল ওই পাড়াটি। প্রতিটি পরিবার ছোট ছোট ঘরে দলবদ্ধভাবে জীবন যাপন করতো। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আর জীবিকার প্রয়োজনে ওরা আস্তে আস্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ওদের সেই ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরের পরিবর্তে আজকে সেখানে গড়ে উঠেছে আধুনিক কালের দালান কোঠা, ঘর বাড়ি।
সেই আশির দশকে কেউ চর্ম শিল্প কেউবা বাঁশ, বেত দিয়ে নানা রকম দ্রবাদি তৈরি করে জীবন অতিবাহিত করত। ঋষি পাড়ায় বসবাস রত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারী- পূরুষেরা ঘরে বসে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঁশ দিয়ে তৈরি করতো হরেক রকমের বর্ণিল রঙের জিনিষপত্র। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-ঝুলন দোলনা, মোড়া, চাঙাড়ী, চালুনি, কুলো, টুকরি, ঝুড়ি, ডালা, মাছ মারার পলো, মুরগি ধরার টাপা, বাজার করার খালোই এবং নানান প্রকার বাঁশি । বাঁশের পাশাপাশি তাঁরা বেত দিয়ে সের, কাঠা, ধামা, মোড়া, ঝুলন দোলনা, ফুলদানি, ইজি চেয়ার, রকিং চেয়ার, সোফা টেবিল ইত্যাদি জিনিসপত্রও তৈরি করতো। বর্তমান প্রজন্মের সদ্য প্রসূত শিশুদের জন্য ঝুলন দোলনার ব্যবহার বা প্রচলন পুরোপুরিভাবে সমাজ হতে উঠে গেছে, এটা এখন স্বপ্নের মত বা যাদুঘরে স্থান রাখার মত হয়ে গেছে।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে সের, কাঁঠা, ধামা, চালন এগুলি কি জিনিষ এবং কি কাজে ব্যবহৃত হতো যদি এই প্রশ্ন করা হয়, বোধহয় একথা শুনে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইবে।
গ্রামীণ জনপদে সেই প্রাচীন বটগাছের সামনে বিশাল খোলা মাঠ, গাছগাছালিতে ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকার সাথে মিতালি করে গভীর রাতে হৃদয় আন্দোলিত করে বাঁশিয়ালের সেই বাঁশির সুর আর তাদের নানান টাইপের রঙবেরঙের বাঁশি কোথায় হারালো? আর সেই সাথে ওই সব তৈরি করার মানুষ গুলিও নিঃশব্দে হারিয়ে গেল। যারা কয়েকজন দৃশ্যমান,তারাও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পেশা বাদ দিয়ে বিভিন্ন পেশায় এখন ঢুকে পড়েছে।
বাঁশ শিল্পের আরেকদল কারিগরের মাগুরার নিজনান্দয়ালী গ্রামে বসবাস করতো। তারা স্থানীয় ভাবে নলুয়া সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত ছিল। তারাও খুবই নিঁপুন ও দক্ষ কারিগর ছিল। তাদের হাতের বাঁশ দিয়ে তৈরি মাছধরার ঘুনি, ভেসেল, চাঙাড়ী ও চাটাই বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য। তৎকালীন আমলে তাদের তৈরি চটার বেড়া, টিনের চাল আর চাটাই দিয়ে নির্মিত ঘরের বেড়া দিয়ে বানানো ঘর প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই শোভা পেত। বর্তমানের চোখ ধাঁধানো জগতে তাদের সুনিপুণ হস্ত শিল্পের স্থলে প্লাষ্টিক আর বিভিন্ন দ্রবাদির দাপটে বিলিন হয়ে গেছে। ওরা টিকে আছে সমাজে কিন্তু তাদের পৈত্রিক পেশা বাদ দিয়ে ভাল ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যোগ্যতানুসারে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। যাক! আমাদের জন্য এটাও একটা ভাল দিক।
শুধু মাগুরা শহর নয়, শ্রীপুর, মহম্মদপুর, শালিখা থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে এই শিল্পীরা।পরিবর্তনের এই ধারায় সবই দখল করে নেবে কলকারখানা। তবে আমাদের স্মৃতির পাতায় থেকে যাবে আবহমান বাংলার এই শিল্পীরা।
সুলতানা কাকলি: লেখিকা, সাবেক গার্লস গাইড