শ্রী ইন্দ্রনীল : দুর্গাপূজা মানেই সার্বজনীন উৎসব। দেবী দুর্গা আমাদের মাঝে মাতৃরূপে বিরাজ করেন, সবার মা। মা সন্তানের সুরক্ষাদায়িনী, সব অপশক্তি বিনাশিনী, মুক্তিদায়িনী, আনন্দময়ী দুর্গা। মায়ের কাছে সব সন্তান সমান, সব সন্তানের কাছে মা অনন্য, তাই মা দুর্গা সর্বজনের, দুর্গাপূজা সার্বজনীন।
দেবীকে বরণ করার জন্য সবাই সমানভাবে উদগ্রীব থাকে। ঘরে ঘরে নারিকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া বানাতে ব্যস্ত থাকেন মায়েরা।
নতুন জামা-কাপড় কেনায় ব্যস্ত হয়ে উঠেন সবাই। আর এসব যে শুধু হিন্দু পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়। এগুলো ছড়িয়ে পড়ে সব ধর্ম-বর্ণ ও গ্রোত্রের মানুষের মধ্যে। জগজ্জননী মায়ের আগমনে এভাবেই হয়ে থাকে ‘সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব’। শরৎকালে অনুষ্ঠিত হয় বলে একে শারদীয় দুর্গোৎসব বলা হয়ে থাকে। শরৎকালটি এমনিতেই প্রকৃতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আরামের মৌসুম। বর্ষার প্রায় শেষদিকে এ সময় মাঝেমধ্যে থাকে আকাশে সাদা মেঘের ঘনঘটা। সেই সাদা মেঘের সাথে রং মিলিয়ে মাঠের কাছে বনের ধারে থাকে সাদা সাদা কাশ ফুল। বিকেল কিংবা রাতের প্রকৃতিতে শুরু হয় তখন আগমনী শীতের বার্তা। ঠিক এমন একটি মুহূর্তেই শুরু হয় শারদীয় সার্বজনীন দুর্গোৎসব।
হিন্দু সম্প্রদায় তাকে মহাশক্তির একটি রূপ মনে করেন। দেবী দুর্গার অনেকগুলি হাত। তার অষ্টাদশভূজা, ষোড়শভূজা, দশভূজা, অষ্টভূজা ও চতুর্ভূজা মূর্তিও দেখা যায়। তবে দশভূজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়। তার বাহন সিংহ (কোনো কোনো মতে বাঘ)। আমরা প্রধানত তাকে মন্দিরে মহিষাসুরমর্দিনী-মূর্তিতে অর্থাৎ মাকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরত অবস্থায় দেখতে পাই। হিন্দুধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী, এবং কালীর অন্যরূপ।
দুর্গা মূলত শক্তির দেবী। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। যেসব পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেগুলি হলো : মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী-ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা হন। বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
হিন্দুশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে :
‘দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।’
অর্থাৎ ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।
অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, ‘দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা।’ দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। অর্থাৎ ‘যিনি দুর্গতি বা সংকট নাশ করেন’, অন্যমতে, ‘যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন’ তিনিই দুর্গা।
আবার শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। তিনিই দুর্গা।
কথিত আছে যে শক্তিশালী রাক্ষস মহিষাসুর একবার ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করেছিলেন কঠোর প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে। সন্তুষ্ট ঈশ্বর যখন তাকে বর দিতে চাইলেন তখন তিনি অমরত্ব চাইলেন। তাকে তা দেয়া না হলে তিনি চালাকি করে বর চাইলেন যে কেবলমাত্র একজন নারী যুদ্ধে তাকে হত্যা করলে তার মৃত্যু হবে। তিনি মনে করেছিলেন, একজন নারী তার শারীরিক শক্তির সাথে কখনো মোকাবেলা করতে পারবে না। সুতরাং তার অমর হওয়ার পথে কোনো বাধা থাকবে না। এ ভাবে শক্তিশালী হয়ে মহিষাসুর পৃথিবী আর স্বর্গে অরাজকতা কায়েম করলেন।
তার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেবতারা তাদের সম্মিলিত বল দিয়ে শক্তি তৈরি করেন (আদিম, মহা জাগতিক, নারী শক্তি) যিনি একজন দেবী এবং তার বিভিন্ন রূপ। তারই একটি রূপ দুর্গা। দেবতাদের দেয়া অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দুর্গা যুদ্ধে গেলেন সিংহে চড়ে। তখন এক দীর্ঘ আর ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়, যার সমাপ্তি ঘটে মহিষাসুর বধ হলে। দেবী দুর্গাকে তাই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ (মহিশাশুরকে যে বধ করেছেন) বলা হয়।
বলা হয় সনাতন হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বারো মাসে তেরো পার্বণ। তবে সব পূজা-পার্বণের মধ্যে দুর্গাপূজা সবচেয়ে বড় মহাযজ্ঞ।
দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুভ মহালয়ার মাধ্যম দিয়ে শুরু হয়। তারপরে প্রথমা, দ্বিতীয়া এভাবে পঞ্চমী পর্যন্ত মূর্তি, প্রতিমা তৈরি ও সাজানোর কাজসহ পূজারম্ভ পর্ব চলতে থাকে। আর পূজার মূল পর্ব শুরু হয় ষষ্ঠীর মাধ্যমে।
তবে এখন প্রশ্ন দুর্গা ষষ্ঠী কেমন? কি তার নিয়ম?
সীতাহরণের পর রামচন্দ্র বানরসেনাদের সাহায্যে সেতুবন্ধ করে লঙ্কায় হাজির হলেন । ব্রহ্মা তখন রামকে আদেশ করলেন অপরাজিতা দুর্গার পুজো করে জগতের উদ্ধারে নেমে পড়তে । সমগ্র রাক্ষসকুলকে ধ্বংস না করতে পারলে যে ধরিত্রীর নিস্তার নেই । তাই কৃষ্ণপক্ষেই নিদ্রিতা দেবীকে অকালে জাগ্রত করে অকালে অর্থাত শরতকালে (পূর্বে বসন্তকালে শুক্লপক্ষে দেবলোক জাগ্রত অবস্থায় পুজো হত) কাজে নেমে পড়েছিলেন রামচন্দ্র স্বয়ং । তাই তো অকাল বোধন । ব্রহ্মার পরামর্শে দেবী দুর্গার দশভুজা মূর্তি মাটি দিয়ে গড়ে ব্রহ্মা স্বয়ং বিল্ব বৃক্ষমূলে সিংহবাহিনী সেই দেবীর বোধন করেছিলেন । সেই দিনটিই ছিল শুক্লপক্ষের মহাষষ্ঠী ।
রামচন্দ্র স্তব করলেন :
নমস্তে ত্রিজগদ্বন্দ্যে সংগ্রামে জয়দায়িনী
প্রসীদ বিজয়ং দেহি কাত্যায়নি নমোহস্তুতে ।।
পূজা শুরু হল । পিতামহ ব্রহ্মা রামচন্দ্রের সাথে বললেন
“হে দেবী! যত দিন না পর্যন্ত রাবণ বধ হয়, রাক্ষসকুল ধ্বংস না হয় আমাদের পূজা গ্রহণ করে তুষ্ট হোন ”
মিথিলার কবি বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী গ্রন্থে ষষ্ঠীতে মায়ের বোধনের উল্লেখ আছেঃ ষষ্ঠ্যাং বিল্বতরৌ বোধঃ সায়ংসন্ধ্যাসুকারয়েত্। বসন্তকালের দুর্গাপুজোয় বোধনের প্রয়োজন হয়না কারণ দেবতারা ঐ সময় জাগ্রত থাকেন। সমগ্র দেবকুলকে শরতকালে জাগানোর উদ্দেশ্যেই এই বোধন। বোধনের অর্থ হল জাগরণ। কালিকাপুরাণে পাওয়া যায় এই বোধন নিয়ে…
“বোধয়েদ্বিল্ব্শাখায়াং ষষ্ঠ্যাং দেবীফুলেষু চ”
মায়েরা উপোস করে নতুন বস্ত্র করে অজ্ঞলি দিয়ে থাকেন। এছাড়া এ দিন মায়েরা আমিষ আর অন্ন গ্রহণ করেন না।দিন শুরু হয় দেবীর মুখ উন্মোচনের সাথে সাথে, আর উৎসবে উপহারে আপামর বাঙ্গালীর মেতে উঠে। দেবী দুর্গার পূজার শুভ আরম্ভ হয় গানে প্রার্থনায় ও আনন্দ সম্ভারে,এখানেই সার্থকতা। আসুন তবে আজকের দিনে ষষ্ঠীর আয়োজনে, আনন্দে ভরে উঠি আমরা, নতুন সাজে ও নতুন আগমনী প্রাতে….
মহাষষ্ঠী। আকাশে বাতাসে রয়েছে মায়ের আগমনীর সুর। আর হবে নাইবা কেন? মা দুর্গা কৈলাসধাম ছেড়ে আজ বাপেরবাড়িতে এসেছেন। তাই আনন্দ আজ দ্বিগুণ। আচ্ছা এবার নিশ্চয় এই প্রশ্নটা মাথায় আসছে, যে ষষ্ঠী কি? আর দুর্গা ঠাকুরের আসার প্রথম দিন ষষ্ঠী কেন?
সাধারণ ভাবে, নবরাত্রি ও দুর্গাপূজা আমরা পর পর পালন করে থাকি। আর নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে দুর্গাপূজা শুরু হয়, তাই এটা দুর্গাষষ্ঠী। একে অনেকে মহাষষ্ঠীও বলে।আসলে ষষ্ঠী হল কোন চান্দ্রমাসের ষষ্ঠ দিন।মায়েরা ষষ্ঠী বুড়ির কাছে সন্তানের মঙ্গল কামনার্থে পূজা দেন।এখানেও সন্তানের মঙ্গল কামনায় মা পূজা দিয়ে থাকেন। তবে মাসে একটা করে ষষ্ঠী আসে, তবে সব ষষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং কিছু ষষ্ঠী যেমন – নীল ষষ্ঠী, জামাই ষষ্ঠী ইত্যাদি।
মহাষষ্ঠীতে বোধন, আমন্ত্রন ও অধিবাস। শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। পূজারম্ভের ধারাবাহিকতায় একে মহাষষ্ঠী বলা হয়। এ মহাষষ্ঠীর আগ পর্যন্ত পূজার যে প্রস্তুতি চলতে থাকে তার পরিসমাপ্তি হয় ষষ্ঠী শুরুর মাধ্যমে। এভাবে পূজা শুরু হওয়ার পরে সেটি সর্বজনীনতা লাভ করতে থাকে।
ষষ্ঠী পূজার দিনে দেবী দুর্গা চার ছেলেমেয়ে গণেশ, লক্ষ্মী, কার্তিক ও সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়ে মর্ত্যভূমিতে পা রাখেন।
এই পৃথিবীতেই উনার পিতার বাড়ি। প্রতি বছর আশ্বিন মাসের শুল্কপক্ষে দূগর্তিনাশিনীকে পৃথিবীতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হিমালয়ের কৈলাসের শিবালয় থেকে পিতৃভুমে ৪ সন্তানকে নিয়ে আসেন মহামায়া।
তাই বিভিন্ন দুর্গামূর্তির মুখের আবরণ সরিয়ে দেবীর মুখমন্ডলের উন্মোচন এই দিন করা হয়। কল্পারম্ভ পুজোর মাধ্যমে মূল পুজোর শুরু হয়। কল্পারম্ভের পরে হয় দেবীর বোধন এবং তারপরে অধিবাস।
ষষ্ঠী পূজার সন্ধ্যায় মূলত মূর্তির উপর থেকে ঢাকা সরিয়ে দেওয়া হয়, কুমোর তুলির এক টানে দেবী দুর্গার চোখ অাঁকেন, যাকে বলা হয় ‘দৃষ্টিদান’, এরপর শুরু হয় ‘কল্পারম্ভ’, ‘বোধন’, আমন্ত্রণ এবং অধিবাস (এসবই পূজার একেকটি অধ্যায়)
বেলগাছের নিচে ধূপ-ধুনো আর ভক্তি মন্ত্র দিয়ে সংকল্প। দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে বরণ করে নিতে সকাল থেকেই শুরু হয়েছে মহাষষ্ঠীর আনুষ্ঠানিকতা। এর মধ্য দিয়েই দেশের সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজার ৫ দিনের উৎসব শুরু হলো।
পুরোহিত মন্ত্রের মাধ্যমে মহামায়াকে জানাচ্ছেন আমন্ত্রণ। আর ভক্তরা মনে-প্রাণে বরণ করে নিচ্ছেন প্রাণের দেবীকে।
পুরাণমতে, নানা আচারের মধ্য দিয়ে এদিন দেবী দুর্গাকে সংকল্প করে প্রণতি জানান ভক্তরা। মায়েরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় করেন নানা প্রার্থনা।
শাস্ত্রীয় মতে, ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভে সায়ংকালে দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস। পূজার প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে শুভ মহালয়া হয়েছে। এদিন থেকেই শুরু হয়েছে দেবীপক্ষ। দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আবাহনের মাধ্যমে দেবীর শুভাগমনের আনুষ্ঠানিক প্রতীক্ষাও শুরু হয়ে গেছে এদিন থেকেই। চন্ডীপাঠ আর অমাবশ্যায় হৃদয়ে নাচন তুলে ঢাকে পড়েছে কাঠি।
দেবী দুর্গার আগমনে বিভিন্ন মন্ডপে ধূপের ধোঁয়ায় ঢাক-ঢোলক, কাঁসর, মন্দিরের চারপাশে পুরোহিতের ভক্তিকণ্ঠে- ‘যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা-নমন্তৈস্য নমন্তেস্য নমোঃ নমোঃ’ মন্ত্র উচ্চারণ অনুরিত হচ্ছে।
– সংগৃহীত ও সংকলিত