অনন্যা হক : সংসারের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে মাঝে মাঝে হাফিয়ে উঠি।খোলা আকাশে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য মন ছটফট করতে থাকে।একটু মাটি পাড়ানো, কিছু টা সবুজ দেখা, আর আকাশের নীলিমায় চোখ মেলে আচ্ছন্ন হতে কার না মন চায়। আমার বান্ধবী কাকলি থাকে রাঙামাটি তে। মাঝে মাঝে যেতে বলতো। মনের কোণে একটু করে ইচ্ছে টা উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল কিছু দিন ধরে, যাই না একবার।
বর, বাচ্চাদের সাথে ছুটি তে মেলে না, তাই বের হতে পারি না। ছোট্ট এ জীবন, একটা করে দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। দেখা হলো না কত কিছু, জানা হলো না কত কিছু। কোথা থেকে একটা সাহস এসে ভর করলো।একদিন মাগুরার এক বন্ধু আন্জুকে কে বলেই ফেললাম। আমাদের যোগাযোগ হতো ফেসবুকে বেশী। বলতেই সে এক কথায় রাজী হয়ে গেল। ওর সাড়া পেয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আর দ্বিমত করিনি। আমরা টেলিফোনেই সব ঠিক করে ফেললাম। সংসার, বর,বাচ্চাদের ছেড়ে একেবারে স্বাধীন ভাবে ছুট দিলাম রাঙামাটির উদ্দেশ্যে। একেবারে ভিন্ন ধরনের যাত্রা, ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা।
এক সকালে রওনা দিয়ে সারা দিন লম্বা জার্নির পর কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। সন্ধ্যা সাত টা নাগাদ পৌঁছলাম।গিয়ে দেখি কাকলি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।আনন্দের সাথে ওর বাসায় গিয়ে উঠলাম। এর আগে পাহাড়ি এলাকায় বরের চাকরির সুবাদে প্রচুর থেকেছি। জার্নি করেছি অনেক।পাহাড় আমার খুব প্রিয়,ঠিক তেমনি করে পাহাড়ি পথে জার্নি টাও অসম্ভব প্রিয়,ছুটে চলার সাথে সাথে অনন্য সুন্দর দৃশ্য দেখার মোহে। এই যাত্রা ছিল শুধু কি মাটি পাড়িয়ে সবুজ দেখা আর খোলা আকাশের নেশা? না, সাথে ছিল আরো অনেক পাওয়া।
একই শহরের একই স্কুল, কলেজের পুরোনো বন্ধুদের সংস্পর্শে থেকে তিন দিন, তিন রাত ইচ্ছে মত আন্তরিক আলাপন, হাসাহাসি,জীবনের গল্প, রাতজাগা, খাওয়া,ঘোরা এবং রাঙামাটির প্রকৃতি দর্শন। প্রথম দিন গাড়ি তে গেলাম গহীন অরণ্যের ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে যাওয়া রাস্তা ধরে কাপ্তাই লেকের ধারে। কাপ্তাই লেক! শুধু পাহাড়ের গা ঘেঁষে পানির বয়ে চলা। এর উৎপত্তি হয়েছে কর্ণফুলী নদীর শাখা প্রশাখা থেকে।কর্ণফুলী নদীর নামকরণের কারণ টা শুনেছি। খুব ভাল লেগেছে শুনে। কোন এক পাহাড়ি মেয়ের কানের দুল সুদূর অতীতের কোন ক্ষণে হারিয়ে গিয়েছিল এই নদীর পানি তে। সেই থেকে এই নদীর নাম নাকি কর্ণফুলী রাখা হয়। সেই কর্ণফুলী নদীর শাখা বেয়ে আসা পানির প্রবাহ এই কাপ্তাই লেকের উৎস। লেকের ধারে বর গাঙ্গ আর আসাম বস্তীর ব্রীজ দেখার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম। গাড়ি টা চলছে।আঁকা বাঁকা, উঁচু নীচু রাস্তা, দু পাশে গহীন জঙ্গল। জনমানুষের চিহ্ন দেখা যায় না।কদাচিৎ দু একটা গাড়ি তে লোকজনের চলাচল চোখে পড়ে।পাহাড়ের একেবারে উপরে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা।
চলতে চলতে বিস্ময় জাগে, যারা রাস্তা তৈরি করেছিল, না জানি কত মেহনত ছিল এর পেছনে। জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে মাঝে মাঝে কাপ্তাই লেকের পানি উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। শুধু চলতে পথেই ছিল অনেক সৌন্দর্যের সমাহার। আমরা গাড়ি থামিয়ে লেকের পাড়ে গিয়ে নামলাম। জায়গা টার নাম বর গাঙ্গ।বাঁশ বাঁধানো বেঞ্চ ছিল সারি দিয়ে বসানো। একটা তে বসলাম। একেবারে শুনশান নিরিবিলি। অল্প লোক জন আছে। সামনে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা লেক, লেকের গায়ে গায়ে পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে সবুজের আবাস। পেছনে বেঁকে চলে গিয়েছে রাস্তা, রাস্তার গা ঘেঁষে আবার উঁচু পাহাড়। কিছু ক্ষণ নীরব হয়ে, মুগ্ধ হয়ে বসে রইলাম। পৃথিবী তুমি এত সুন্দর! এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে নীরবতাই শ্রেয়। ওখান থেকে গেলাম আসাম বস্তীর ব্রীজের উপর।ফিরে এলাম সেদিন পর্যটন হয়ে বাসায়।
পরদিন সকাল থেকে তোড়জোড় শুরু হলো সুবলং যাওয়ার। পরিচিত লঞ্চ ঠিক করা ছিল। একটা দ্বিতল লঞ্চ, উপরে ছাউনি দেওয়া। আমরা উপরে গিয়ে বসলাম।লঞ্চ চলতে শুরু করলো। উপরে হেমন্তর খোলা মেঘ মুক্ত আকাশ,চকচকে অথচ মিষ্টি একটা রোদ, হালকা ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে মৃদু ছুঁয়ে যাচ্ছে। লঞ্চ টা হেলে দুলে চলছে। অপরূপ সৌন্দর্যে তিন নারী হঠাৎ উচ্ছ্বল হয়ে উঠলাম। চললো এলোপাথাড়ি ছবি তোলার হিড়িক। একটু বেশী নড়লেই লঞ্চ টা দুলে উঠছিল। তবুও ভয় যেন কোথায় পালালো। প্রকৃতির সংস্পর্শে যেন মুক্ত বিহঙ্গ মনে হলো নিজেদের। পাশ দিয়ে ছুটে চলছিল আরো লঞ্চ, মোটর চালিত নৌকা। কোন টা পণ্যবাহী, কোন টা মানুষ পারাপার করছে। সে গুলোর পানির ঝাপটা গিয়ে ধুয়ে দিচ্ছিল পাহাড়ের গা। লেকের পানি পাহাড়ের গা ঘেঁষে দু তিন দিকে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে। আমরা সুবলং এর দিকে যাচ্ছিলাম। যাত্রা পথ টাই ছিল অপূর্ব সুন্দর। লঞ্চ গিয়ে সুবলং এর ঘাটে ভিড়লো। ওখানে ছিল ছোট একটা খাবারের দোকান, একটা পাহাড়ি জিনিসের দোকান। ওখান থেকে সুস্বাদু সামুচা খেলাম। পাহাড়ের গায়ে মাটির রাস্তা ধরে কিছু টা উঠে গিয়ে দেখলাম কাছ থেকে সুবলং এর ঝর্ণা। পানির উৎসে ভাটা থাকায় হালকা ঝিরঝিরে ঝর্ণা ধারা দেখার ভাগ্য হলো।পাহাড়ের গা বেয়ে একটা রিনিঝিনি সুর তুলে পানি পড়ছে অবিরাম।তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো, যদি উপরে গিয়ে দেখতে পেতাম এর উৎস কোথায় কেমন করে বয়ে চলে।
কি অপার রহস্য লুকিয়ে থাকে এর ভেতরে ভাবতে গেলে, প্রকৃতির উচ্ছ্বলতার কাছে নিজের উচ্ছ্বলতা হারিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আবার ফিরে এলাম লঞ্চে। লঞ্চ ফিরতে শুরু করলো। লেকের ভেতরে ভেতরে ছোট দ্বীপের মত ছিল কতগুলো। সে রকম একটা তে লঞ্চ ভিড়িয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।মেনু ছিল কাকলির রান্না মোরগ পোলাও আর ডিম ভোনা। এরপরে ছোট দ্বীপ টা তে কিছু সময় বসে থাকলাম। যেদিকে তাকাই পানি, পাহাড়, সবুজ আর আকাশ। পানি, সবুজ, আকাশ, পাহাড়ের এক সঙ্গম স্হল যেন রাঙামাটির গা ঘেঁষে কাপ্তাই লেক।বিমোহিত মন, কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম নিজেদের পিছুটানের সব হাতছানি গুলো কে।
এই রাঙামাটি ভ্রমণটা আমাদের তিন জনের জীবনে যেন এক পশলা বৃষ্টির মত এক আনন্দ উপভোগের সুযোগ করে দিল। একটা ভিন্ন অনুভবের আমেজ গেঁথে দিল আজীবন মনে রাখার মত। এটা আমার জীবনের এক সমৃদ্ধ স্মৃতি হয়ে থাকবে।