আজ, রবিবার | ১৫ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | সকাল ৯:৫১


রাজনীতিক ইকবাল আখতার খান কাফুর এবং কিছু কথা

জাহিদ রহমান : খুলনা বিভাগের রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ, বিএনপি নেতা, মাগুরার সাবেক পৌর মেয়র ইকবাল আখতার খান কাফুর চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন গত ৯ জানুয়ারি। ‘কাফুর ভাই’ হিসেবেই তাঁর জনপরিচিত ছিল মাগুরার সর্বত্র।

বেশ কিছুদিন ধরেই কাফুর ভাই অসুস্থ ছিলেন। ৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার যশোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১১ জানুয়ারি শহরের নোমানি ময়দানে জানাযা শেষে তাঁকে পৌর গোরস্থানে দাফন করা হয়।

ইকবাল আকতার খান কাফুরের পিতা মসিউল আজম ছিলেন পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের প্রাজ্ঞ ডেপুটি স্পিকার। স্বভাবতই পিতার আদর্শ আর পারিবারিক ঐতিহ্যে ইকবাল আখতার খান কাফুর রাজনীতির ময়দানে বরাবরই ছিলেন পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল ভাবমূর্তির এক নিপাট ব্যক্তিত্ব। বলতে দ্বিধা নেই মৃত্যু অব্দি সেই ভাবমূর্তি তিনি অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর তাইতো তাঁর শেষ বিদায়ের ক্ষণে জানাযার প্রার্থণায় দলমত নির্বিশেষে মানুষের ঢল নেমেছিল।

মাগুরার রাজনীতিতে বর্ষিয়ান এই নেতার দল মত নির্বিশেষে সার্বজনীন একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি ছিলেন ভীষণরকম সদালাপী, মৃদুভাষী, নিরহংকারী। দীর্ঘদিন ধরে পৌরবাসীর তিনি সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। নিভৃতচারী এক সেবক হিসেবে  তিনি অনন্য উদাহরণও তৈরি করে গেছেন। পৌর নির্বাচনে তিনি একাধিকবার জয়ী হন। মাগুরা পৌরসভাতে তিনিই সবচেয়ে বেশি তিনবার পৌরমেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে তিনি একাধিকবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও কখনই জয়ী হতে পারেননি। কিন্তু তিনি বাববারই ভোটের লড়াই-এ প্রমাণ করেছিলেন প্রতিটি গ্রামে তাঁর নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক রয়েছে।

১৯৮৩ সালে ইকবাল আখতার খান কাফুর প্রথম মাগুরা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এরপর ১৯৮৪ সালে প্রথম পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। সেবার পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচনে ইকবাল আখতার খান কাফুরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মাজেদ খোন্দকারসহ বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান, সাবেক টাউন চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলী খান, ব্যবসায়ী বজলুর রহমান এবং মোখলেসুর রহমান। নির্বাচনে ইকবাল আখতার খান কাফুর ৩ হাজার ৬০৬ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগ সমর্থিত আব্দুল মাজেদ খোন্দকার ২ হাজার ৪০৭ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। ১ হাজার ৮৩২ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান। ১ হাজার ৬০৯ ভোট পেয়ে চতুর্থ হন ওয়াজেদ আলী খান। পঞ্চম স্থানে থাকা বজলুর রহমান ৮২৪ ভোট এবং সর্বশেষ অবস্থানে থাকা মোকলেছুর রহমান পান ৫১৮ ভোট। এরপর দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ১৯৮৯ সালে ফের পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে তিনি ৭ হাজার ৩০৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আলতাফ হোসাইন ৫ হাজার ৯৩১ ভোট পান। স্বতন্ত্র প্রার্থী সাহেব আলী পান মাত্র ৫১ ভোট।

২০১৩ সালে তিনি আবারও উপ-নির্বাচনে পৌরমেয়র নির্বাচিত হন। এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি পৌরমেয়র ও বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ আলতাফ হোসেন ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে ৬ মে  উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে আলতাফ হোসেন ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে ২৩ হাজার ১৪৫ ভোট পেয়ে  মেয়র পদে জয়লাভ করেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি হাসান সিরাজ সুজা পান ১২ হাজার ৩৪৭ ভোট।

৬ মে উপনির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাওয়া  ইকবাল আখতার খান কাফুর তালা প্রতীকে ১৪ হাজার ৭৩৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগের খুরশিদ হায়দার টুটুল আনারস প্রতীকে ৯ হাজার ৪৭৪ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তপন রায় ৮ হাজার ৯২৭ ভোট পান। বিএনপি সমর্থিত আরেক প্রার্থী মাহাবুবুল হক ৫ হাজার ০৯৩ ভোট পেয়ে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। জাতীয় পার্টির হাসান সিরাজ সুজা ৪ হাজার ১৬৭ ভোট পেয়ে সর্বশেষ স্থানে থাকেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে পৌরমেয়র নির্বাচনে ইকবাল আখতার খান কাফুর আওয়ামী লীগ প্রার্থী খুরশিদ হায়দার টুটুলের কাছে পরাজিত হন। অবশ্য এই নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তিনি কারচুপির অভিযোগ এনেছিলেন।

ইকবাল আখতার খান কাফুর মৃত্যু অব্দি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতির শুরুটা ছিল তাঁর মুসলিম লীগের হয়ে। ৮৬ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-১ আসনে প্রাথী হয়ে হারিকেন প্রতীকে ১৪ হাজার ৪৫৬ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন। সেবার ৪৫ হাজার ৩৮৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মেজর নেজারেল (অব.) এম এ মতিন। ২৩ হাজার ৭৬২ ভোট পেয়ে পরাজিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আলতাফ হোসেন। ৯৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে প্রার্থী হয়ে মাগুরা-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ৪৯ হাজার ৫৯৪ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া ডা. মো. সিরাজুল আকবর (এমএস আকবর) ৭৩ হাজার ৫৪৩ ভোট পেয়ে জয়ী হন। এরপর ১৯৯৭ সালে জাতীয় পার্টি ছেড়ে তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকে মাগুরা-১ আসনে মনোনয়ন লাভ করেন। নির্বাচনে মাগুরা-১ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে মহাজোটের প্রার্থী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ সিরাজুল আকবর (এমএস আকবর) ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ১২১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন এবং বিএনপির প্রাথী মো. ইকবাল আখতার খান কাফুর ১ লক্ষ ০৯ হাজার ৮৩৫ ভোট পেয়ে পরাজিত হন।

সদ্য প্রয়াত রাজনীতিক ইকবাল আখতার খান কাফুর কখনই উড়ে এসে জুড়ে বসা কোনো নেতা ছিলেন না।  পিতার পরিচয় আর পারিবারিক ঐতিহ্যে তাঁর জনপরিচিতির ভিত্তিটা মজবুত ছিল আগে থেকেই। রাজনীতি এবং নির্বাচন দুটোই ভীষণ পছন্দ ছিল তাঁর। একসময় আমেরিকা প্রবাসী হলেও রাজনীতি থেকে কখনই বিচ্যুত হননি। বরং রাজনীতির টানেই বারবার ফিরে এসেছেন মাগুরার মাটিতে। এবারও ফিরে এসেছিলেন দীর্ঘ বিরতির পর। রাজনীতির ময়দানে সক্রিয়ও ছিলেন। কিন্ত প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মাটির কোলে ফিরে যেতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর শূন্যতা কিছুটা হলেও অনুভব করছে মাগুরাবাসী। হয়ত সামনে আরও করবে। দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বাজারে পারিবারিক ঐতিহ্য আর শিক্ষা-আভিজাত্যে বেড়ে ওঠা এ ধরনের নিপাট, পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ সামনে আরও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

লেখক-ফ্রিল্যান্সার, কলামিস্ট এবং সম্পাদক, মাগুরা প্রতিদিন ডটকম

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology