জাহিদ রহমান: মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার জোকা গ্রামের হুজুর আলী সাঁই। একতারা বাজিয়ে এ গ্রাম ও গ্রামে গান করে বেড়ান। গানের মধ্যেই মানবতা, ভালোবাসা, প্রেমভক্তি, ইশ্বর-আরাধনার কথা তুলে ধরেন। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিবাগী এ মানুষ একতারাকে সম্বল করেই বেঁচে আছেন। যাপিতজীবনে তাঁর তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। অর্থবিত্তের প্রতি তার নেই কোনো লোভ । চিত্তকে শুদ্ধ করে গানই তাঁর বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। গানের সুরই সাধাসিধে এই মানুষটির জীবনকে করেছে পরিপূর্ণ।
তবে দু-মুঠো ভাত-এর লড়াইটা তার এখনও একতারা বাজিয়ে। কেউ অনুরোধ করলে একতারে টান দিয়ে লালন ফকির, পাঞ্জু শাহ বা হাতেম শাহর কোনো গান উচ্চারণ করেন। কারো সাহায্য চান না তিনি, তবে গান শুনে কেউ ভক্তি করলে অভিবাদন জানান। পাঞ্জু শাহ-এর ‘ধর্ম বলতে তুমি ধর্ম, কর্মফল গেলো না, পাপী বলে আমায় ফেল না’, জহুর শাহ-এর ‘নবী উম্মতের ভার কবুল করে উদয় হলেন মদীনায়’, লালন শাহ-এর ‘শুনিলে প্রাণ চমকে উঠে, দেখতে যেমন ভুজঙ্গনা, যেখানে সাঁইর বারামখানা’-এ গানগুলো তাঁর খুব পছন্দ। নিত্য এই গানগুলো মানুষের গেয়ে শোনান তিনি।
যৌবনে কাপড় বোনার কাজ করতেন হুজুর আলী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন পালাগানের দলে জুরি ও করতাল বাজাতে শুরু করেন। ভাল জুরি বাজাতেন তিনি। একসময় কাপড় বোনার কাজ ছেড়ে দিয়ে গানে মত্ত হয়ে পড়েন। আত্মশুদ্ধির পথ খুঁজে নেন গানের ভেতরেই। গান গাইতে লালনের ছেঁউড়িয়া থেকে শুরু করে বহু গ্রাম গঞ্জে গিয়েছেন হুজুর আলী। অনেকের সাথে তাঁর দেখা সাক্ষাৎও হয়েছে। অনেকের সাথে রয়েছে তাঁর সুখ স্মৃতি। তবে ভুলতে পারেন নি ঝিনেদার শৈলকূপার ধাওয়া গ্রামের গায়ক নিয়ামত ফকির, কচুয়ার ছমিরউদ্দিন, বাসুদেবপুরের আনন্দমোহন, কুমারখালীর পান্টির জিতেন গোঁসাই, শৈলকূপার নড়া গ্রামের মতলেব শাহ, শ্রীপুরের মালাইনগরের আবু তালেব বয়াতী, ইছাপুর-গয়েশপুরের সাহেব আলীসহ অসংখ্য গায়েনের কথা। শ্রীপুরের ওয়াপদার দবির ফকির, বরিশাটের আফজাল ফকির ও মকবুল ফকিরকে তিনি কাছ থেকে গান গাইতে দেখেছেন। আর সারঙ্গদিয়ার প্রয়াত মেটন ফকিরের নাম শুনলে এখনও প্রণাম করেন। বলেন, ‘মেটন ফকির বড় মাপের এক সাধক। তাঁর নাম শুনলে প্রণাম না করে পারা যায় না।’
হুজুর আলী সাঁই দুই ছেলে আর দুই মেয়ের জনক। স্ত্রীও বেঁচে আছেন। শরীর ভালো থাকলে এখনও প্রতিদিন সকালে হুজুর আলী সাঁই একতারা হাতে বেরিয়ে পড়েন। পথ থেকে পথে ঘুরে বেড়ান অচিন মানুষের সন্ধানে।