জাহিদ রহমান : বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন খুব সহসাই মরণঘাতক করোনা ভাইরাস যাচ্ছে না। বরং দিন যতই যাচ্ছে ততই করোনা ভাইরাস তার রূপ পাল্টিয়ে নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। ফলে এই ভাইরাস সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভ্যারিয়েন্টের কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। এ পর্যন্ত যে সব ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, যার আরেক নাম ই.১.১.৭, ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট চ.১, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ই.১.৬১৭ সহ আরও কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট।
ইতোমধ্যেই করোনা ভাইরাসের বিপুল সংক্রমণ ঠেকাতে বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েক ধরনের টিকা তৈরি করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন, জনসন এন্ড জনসন, সিনোফার্ম ভ্যাকসিন, মর্ডানা ভ্যাকসিন, ফাইজার ভ্যাকসিন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ভাইরাস থেকে নিজেকে বাঁচাতে করোনা প্রতিরোধের টিকা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত চার ধরনের টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ বছরের ২১ জানুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ টিকা উপহার হিসেবে ভারত থেকে প্রথম আমাদের দেশে আসে। এরপরই টিকাদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। সেই মোতাবেক ২৭ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে টিকা দান শুরু হয়। এদিন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র নার্স রুনু ভেরোনিকাকে প্রথম টিকা দেওয়া হয়। এরপর ৭ ফেব্রয়ারি থেকে পর্যায়ক্রমে গণ টিকাদান শুরু হয়। মাঝে টিকার স্বল্পতার কারণে টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয়। ২৫ জানুয়ারি ভারতে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির প্রথম চালানের ৫০ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দেশে আসে।
এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার পর ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা ২০ লাখ ডোজ অ·ফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ঢাকায় পৌঁছে। ২৬ মার্চ ঢাকায় পৌঁছে ভারতীয় উপহারের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১২ লাখ ভ্যাকসিন।
৮ এপ্রিল ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নরভানে ঢাকায় বাংলাদেশের (তৎকালীন) সেনাবাহিনীপ প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কাছে ১ লাখ অ·ফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন হস্তান্তর করেন।
১ মে চীন বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে প্রথম দফায় ৫ লাখ সিনোফার্মের ভ্যাকসিন প্রদান করে। ৩১ মে দেশে এসে পৌঁছায় টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যা· প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারের টিকা ফাইজার বায়োএনটেক কোভিড-১৯ এর ১ লাখ ৬২০ ডোজ টিকা। ১৩ জুন চীন থেকে সিনোফার্মের ৬ লাখ উপহারের ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় চালান ঢাকায় আসে।
২ জুলাই রাত ১১টা ২২ মিনিটে টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপহার মডার্নার ১৩ লাখ করোনার ভ্যাকসিন দেশে এসে পৌঁছায়। এরপর ৩ জুলাই রাত ১২টা ৩৪ মিনিটে চীনের সিনোফার্ম থেকে কেনা ১১ লাখ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন ঢাকায় আসে।
৩ জুলাই ভোর সাড়ে ৫টার দিকে দ্বিতীয় ধাপে চীনের সিনোফার্ম থেকে কেনা ৯ লাখ ভ্যাকসিন আসে। একই দিনে সকাল পোনে ৯টায় টিকার কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপহার মডার্নার তৈরি প্রায় সাড়ে ১২ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেশে আসে। এদিকে ১৭ জুলাই চীন থেকে কেনা সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের ১০ লাখ ডোজ ঢাকায় আসে। ১৮ জুলাই আরও ১০ লাখ ডোজ আসে।
১৯ জুলাই সোমবার আমেরিকা থেকে কোভাক্সের আওতায় পাঠানো মর্ডানার ৩০ লক্ষ টিকা গ্রহণ করে বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে টিকা সরবরাহের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম কোভাক্সের আওতায় জাপান থেকে ২ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ ডোজ অ·ফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার টিকাও সম্প্রতি এসেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে অধিক সংখ্যক টিকা আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত বিষয়ক দাতব্য প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল চেঞ্জ ডাটা ল্যাব জানাচ্ছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অন্তত ২৭.০১ শতাংশ মানুষ এখন পর্যন্ত এক ডোজ করে টিকা পেয়েছেন। দুই ডোজ করে টিকা পেয়েছেন ১৩.৭ শতাংশ মানুষ। এদিকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার ২.৬০ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা নেওয়া সম্পন্ন করেছে। এক ডোজ টিকা গ্রহণ করেছে ১.০৬ শতাংশ। শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকা কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন টিকার পাশাপাশি সংক্রমণ প্রতিরোধে যে সব নিয়মকানুন মেনে চলা প্রয়োজন সেগুলো অনুসরণ করতে হবে। নিয়মিত হাত ধোঁয়া, সেনিটাইজার ব্যবহার করা, ফেস মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দুরুত্ব রক্ষা করা-এগুলো সঠিকভাবে মানতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, যে কোনো ভাইরাসই ক্রমাগত নিজের ভেতরে নিজেই মিউটেশন ঘটাতে থাকে অর্থাৎ নিজেকে বদলাতে থাকে, এবং তার ফলে একই ভাইরাসের নানা ধরন তৈরি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে তেমন মাথাব্যথার প্রয়োজন হয় না কারণ নতুন সৃষ্ট অনেক ভ্যারিয়েন্ট মূল ভাইরাসের চেয়ে দুর্বল এবং কম ক্ষতিকর হয়। কিন্তু কিছু ভ্যারিয়েন্ট আবার অধিকতর ছোঁয়াচে হয়ে ওঠে-যার ফলে টিকা দিয়ে একে কাবু করা করতে হয়।
বাংলাদেশে এখন করোনার যে দ্রত সংক্রমণ বা বিস্তার তা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। এ বিষয়টি বেশ আগেই নিশ্চিত করেছে রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ। মূলত সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করে। প্রথমে দেখা যায় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মানুষ তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। সেই আক্রান্তের হার দ্রুতই বাড়তে থাকে বিধায় সরকার দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন দিতে বাধ্য হয়।
করোনাভাইরাসের ভারত ভ্যারিয়েন্ট-যেটার বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে বি.১.৬১৭- প্রথম ভারতে শনাক্ত হয় গত বছরের অক্টোবর মাসে। এই ধরণটিকেই ‘ডেল্টা’ বলা হচ্ছে। এর আগে সংক্রামক রোগের তথ্য সংগ্রহ ও আদান প্রদানে নিয়োজিত আর্ন্তজাতিক সংস্থা জিআইসএইড-এর ডাটাবেজ জানিয়েছিল ২০টিরও বেশি দেশে ভারতীয় ধরনের করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে।
এদিকে গত বছরের শুরুতে মাগুরা জেলার মাগুরা সদরসহ চারটি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ খুব কম থাকলেও তা যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক গুণে বেড়েছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আসার পর পুরো চিত্রই পাল্টে গেছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে এবং করোনা উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে, হাসপাতালে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। বেশিরভাগ রুগি শ্বাসকষ্ট সমস্যা নিয়ে মৃত্যুবরণ করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা যেভাবে বেড়ে চলেছে এতে করে পূর্ণ সতর্কতার বিকল্প নেই। মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাচলের বিকল্প নেই।
লেখক : জাহিদ রহমান, সম্পাদক, মাগুরা প্রতিদিন।