জাহিদ রহমান : পরশু ৭ জানুয়ারি সারাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে যোগ্য প্রতিদ্ব›দ্বী না থাকার কারণে এই নির্বাচন ঘিরে মাগুরাতে প্রতিযোগিতাপূর্ণ লড়াই হবে-এমন কোনো উত্তেজনা নেই। তবে প্রতিযোগিতার উত্তেজনা না থাকলেও মাগুরা-১ আসনে বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার মাগুরার সন্তান সাকিব আল হাসান মনোনয়ন পাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ আর গণমাধ্যমের কাছে এই আসন নিয়ে উদ্দীপনা ও উৎসাহের কোনো শেষ নেই। সাকিবের কারণেই সোশাল মিডিয়াতেও মাগুরার নির্বাচনে সাকিবের অংশগ্রহণ নিয়ে চলছে নানান কথামালা। দেশের সর্বত্রই তাঁকে নিয়ে কম বেশি আলোচনা চলমান। আর বিভিন্ন চ্যানেলে এই ক্রিকেট আইকনের নির্বাচনী প্রচারণার খবর যেনো এখন অবধারিত।
মাগুরা-১ আসনে তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান আওয়ামী লীগ থেকে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন একই দলের হেভিওয়েট প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মো. সাইফুজ্জামান শিখরের বদলে। মনোননয় নিয়ে শুরুতেই এই আসন নিয়ে চলমান ছিল নানান ধরনের অনুমান, আলোচনা ও বিশ্লেষণ। কিন্ত মনোনয়নের খেলায় শেষমেষ সাকিবই জয়ী হন। সাকিব আল হাসান মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রথম যেদিন মাগুরাতে যান সেদিন হাজার হাজার জনতার ভালোবাসায় সিক্ত হন। তখনই অনুমিত হয়েছিল মাশরাফির পর তাঁকে নিয়ে হইচই হবে সর্বত্র।
মাগুরা-১ আসনে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্ধী নেই। কিন্তু না থাকলেও সাকিব আল হাসান বসে থাকেননি। নিজের বিজয় বেশি ভোটে নিশ্চিত করতে মাগুরা সদর এবং শ্রীপুর উপজেলার সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন। প্রচারণার ইনিংসে সারাদিনই তিনি দলীয় নেতাকর্মীসহ জনগণের সাথে কাটিয়েছেন, জনগণের মাঝে থেকেছেন। এখানেই শেষ নয়, সাকিবের কারণেই মাগুরা শহর যেনো তারকাময়ও হয়ে ওঠে। তাঁর সমর্থনে একাধিক বর্তমান ও সাবেক তারকা ক্রিকেটার মাগুরাতে অবস্থান করেন এবং প্রচার-প্রচারণাতে সামিল হন। এমন কী নড়াইল সদর আসনের এমপি, সাবেক তারকা ক্রিকেটার ‘ম্যাশ’ খ্যাত মাশরাফি বিন মুর্তুজাও প্রচারের শেষ দিন ৪ জানুয়ারি মাগুরাতে যান। সাবেক তারকা ফুটবলার কায়সার হামিদকেও দেখা গেছে সাকিবের প্রচারণায় শরীক হতে। মাগুরাতে তাই সাকিবকে ঘিরে উচ্ছ¡াস-উদ্দীপনা ছিল অবিরাম অবিরত।
মাগুরা সদর এবং শ্রীপুর উপজেলা নিয়ে মাগুরা-১ আসন গঠিত।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী, সাবেক ছাত্রনেতা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস মো. সাইফুজ্জামান শিখর ২ লাখ ৭৪ হাজার ১৩০ ভোট পেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ী হন। এবারও সবার ধারণা ছিল ‘প্রোপিপল’ নেতা হিসেবে খ্যাত তিনিই নিশ্চিত মনোনয়ন পাবেন। কেননা তরুণ নেতা হিসেবে কানেকটভিটি এবং অবকাঠামোসহ মাগুরার অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন করে তিনি সবার নজর কেড়েছিলেন। কিন্তু সব অনুমান মিথ্যে করে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন লাভ করেন সাকিব আল হাসান। প্রথম প্রথম সাকিব আল হাসানকে নিয়ে নানান ধরনের প্রশ্ন ও সংশয় তৈরি হলেও আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীই পরবর্তীতে সক্রিয়ভাবে তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রচার-প্রচারণায় সামিল হন। সাকিব আল হাসান এ পর্যন্ত মাগুরা শহর এবং মাগুরা সদর ও শ্রীপুর উপজেলার সবকটি ইউনিয়েনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিভিন্ন ধরনের সভা ও পথসভাতে অংশ নিয়েছেন। অংশ নিয়েছেন ১৪ দলের শরীক দল জাসদ আয়োজিত নির্বাচনী সভাতেও।
এখানেই শেষ নয়, প্রতিদিন সকালে রুটিন করে তিনি কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বাইকে চড়ে ওয়ান টু ওয়ান মানুষের সাথে কথা বলেছেন। এই প্রচারণায় তিনি নিজ শহরের কলেজ পাড়াও বাদ রাখেননি। সেখানেও বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। প্রবীণ ব্যক্তিদের আর্শীবাদ নিয়েছেন। বিভিন্ন মার্কেটে গিয়ে ব্যবসায়ী, দোকানী, সেলসম্যানদের হাতে নিজের প্রচারপত্র-লিফলেট তুলে দিয়েছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। এককথায় সাকিবের প্রচারণা ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে এটি সত্য সাকিব যেখানে গিয়েছেন সেখানেই শত-হাজারো ভক্তের উপস্থিতি পেয়েছেন। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী, শিশুরা সাকিবকে দেখতে ভীড় জমিয়েছেন। শুধু ভীড় নয়, যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই তাঁর ক্ষুদে ভক্তরা একটি অটোগ্রাফের আশায় প্রিয় ক্রিকেট ব্যাট, খাতা, জার্সি, ফোন কাভার এগিয়ে দিয়েছেন। মাগুরা শহরসহ বিভিন্ন জায়গাতে গিয়ে বাচ্চাদের সাথে ক্রিকেটও খেলেছেন। সাকিব কাউকে নিরাশ করেননি। যথাসাধ্য হাসিমুখে সবাইকে খুশি করতে তৎপর থেকেছেন। শত বিড়ম্বনাও পড়তে হয়েছে তাঁকে।
সোশাল মিডিয়াতে সাকিবের ভোট প্রার্থণার প্রচার-প্রচারণার অনেক ছবি ঘুরছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে সাকিব কোনা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে ভোট প্রার্থণা করছেন। আবার কোথাও পাটি বা মাদুরে বসে সাধারণ মানুষের সাথে খাবার খাচ্ছেন। কোথাও বসে মুড়ি মাখানো বিতরণ করছেন। এসব চিত্রের মাঝে একজন অসাধারণ সেলিব্রেটি ক্রিকেটার যেন কেবলই সাধারণ হয়ে উঠেছেন। সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাকিবের প্রচার-প্রচারণা এক অর্থে সবার নজর কেড়েছে। বড় কথা জয় নিশ্চিত হলেও সাকিব বসে থাকেননি। সাকিব দিনরাত গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে চলেছেন। আর তাই দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও প্রতিদিনই সাকিবকে নিয়ে প্রচার প্রচারণার কোনো না কোনো রিপোর্ট করতে দেখা গেছে।
সাকিব ক্রিকেট ময়দানে এতদিন জয় বা পরাজয়ের পর পৃথিবীর সেরা উপস্থাপক বা ক্রিকেট কমেন্টেটরদের সামান্য প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও প্রথমবারের মতো রাজনীতিতে নেমে শতাধিক সভায় দাঁড়িয়ে তাঁকে বক্তব্য দিতে হয়েছে। রাজনৈতিক বক্তব্য বরাবরই দেওয়া একটু কঠিন। কেননা স্থান-কাল-পাত্র বুঝে বক্তব্য উপস্থাপন করতে হয়। একই সাথে দল বা পাড়া মহল্লার একজন সাধারণ কর্মীও যাতে কোনো বক্তব্যে মনক্ষুন্ন না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রেও সাকিব খারাপ করেননি।
অনেকেই বলছেন রাজনীতির ময়দানে এখন পর্যন্ত সাকিব বোলিং-ব্যাটিং-ফিল্ডিং সবাই ভালো করছেন। রাজনীতির ইনিংসে তাঁর নো বল নেই বললেই চলে। ডট বলও নেই। নির্বাচনী ফিল্ডের ফিল্ডিংটাও তিনি এখন পর্যন্ত ভালো সাজিয়েছেন। তিনি নিশ্চিত বুঝেও গেছেন রাজনীতি কোনো টি- টোয়েন্টি বা ওয়ানডে ম্যাচ নয়। এটি সত্যিই টেস্ট ম্যাচ। এই ম্যাচের প্রথম ইনিংস যত দীর্ঘ করা যাবে ততই মঙ্গল। সাকিব আপাতত সেভাবেই সুন্দর সূচনা করেছেন।
মাগুরা-১ আসনে এর আগে ৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে পরপর পর চারবার সংসদ সদস্য ছিলেন অধ্যাপক ডাক্তার সিরাজুল আকবর। সর্বশেষ তিনি রেডক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানেরও দায়িত্বে ছিলেন। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালের ৯ মার্চ আকস্মিভাবে মারা যান ডাক্তার এমএস আকবর এমপি। এরপর এই আসন শুন্য ঘোষণা করে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আব্দুল ওয়াহহাব ৯৩ হাজার ১৮১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। ¯^তন্ত্র প্রার্থী তপন কুমার রায় ১২ হাজার ৭৯০ ভোট পান। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে মো. সাইফুজ্জামান শিখর জয়ী হয়ে মাগুরার উন্নয়নের স্টিয়ারিং ধরেন। মাগুরা ও শ্রীপুরে পরিবর্তনও আনেন।
৭ জানুয়ারি মাগুরা-১ আসনে সাকিবের প্রতিদ্বন্ধী জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বিএনএফ, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরা। এসব দলের কোনো প্রার্থীই কোনো ধরনের প্রতিদ্বন্ধিতা গড়ে তুলতে পারবেন না। সাকিব আল হাসানের বিজয় সুনিশ্চিত। তবে সাকিব আল হাসান কত ভোট পান সেটাই এখন দেখার বিষয়। সাকিব নিজেই বারবার অনুরোধ করে ভোটারদের বলেছেন, ‘ আপনারা ভোট কেন্দ্রে আসবেন, আপনার ভোটটি দেবেন।’ তবে ধারণা করা হচ্ছে সাকিব অনেক বেশি ভোট টানতে সক্ষম হবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ৭ জানুয়ারি রাজনীতির ময়দানে সাকিবের প্রথম ইনিংস শেষ হবে। জয়ের পরে শুরু হবে দ্বিতীয় ইনিংস। মনে রাখতে হবে সাকিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ¯^প্নের এক প্রার্থী। ফরিদপুরের জনসভায়ও তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশেই ছিলেন। রাজনীতির ইনিংসে টেকসই ব্যাটিংটা তিনি বুঝে শুনেই করবেন।