আবু বাসার আখন্দ : মাগুরায় দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিজ নিজ ইউনিয়নের মধ্যে সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন হাসিনা বেগম এবং সাথী আকতার। সদর উপজেলার চাউলিয়া ইউনিয়ন থেকে দ্বিতীয় বারের মতো হাসিনা। আর সাথী আকতার প্রথম বারের মতো নির্বাচিত হয়ে জনগণের সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন। বিগত সময়ের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তারা নির্বাচিত হয়েছেন। তারা স্বপ্ন দেখেন সুন্দর বাংলাদেশের। সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা তাদের চোখে-মুখে।
হাসিনা বেগম#
অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন করেন হাসিনা বেগম। ২০১১ সনে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি প্রথম সংরক্ষিত ৩নং ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হন। সে সময় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সম্মানি পাওয়া যেতো মাত্র ৯শ টাকা। কখনোই সেই অর্থ বাড়িতে নিতে পারেন নি। পথেই ফুরিয়ে গেছে। শহরের প্রবেশমুখে বাসস্ট্যাণ্ডে স্বামী ওসমান গণির চায়ের দোকান। তার থেকেই চলে সংসার। এ অবস্থায় গ্রামের সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। কিন্তু হতাশ হননি কখনও।
পারলা পূর্বপাড়ায় হাসিনা বেগমের বাড়ি। বসত ঘরের টিনে জঙ ধরেছে। কাঁচা মাটির মেঝে স্যাঁতসেঁতে। সেদিকে নজর নেই তার। কিন্তু পায়ে হেটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে খোঁজ রাখেন মানুষের। প্রতিবেশিরা যখন বিপদ দেখে ঘরের দরজা আটকে দেন ঠিক তখনই পাওয়া যায় হাসিনাকে। এলাকায় দু’টি পক্ষের মধ্যে চলছে দাঙ্গা হাঙ্গামা; সেখানেও হাজির। তাইতো এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় মানুষ হাসিনা বেগম।
কয়েক বছর হলো স্বামী মারা গেছেন। তার চায়ের দোকানে বসিয়ে দিয়েছেন বড় ছেলেকে। তার অর্থেই চলছে সংসার। আর হাসিনা বেগম একই ভাবে করে চলেছেন সমাজ-সংসার।
হাসিনা বেগম বলেন, রাজনীতি কখনোই করিনি। কিন্তু মানুষের বিপদ দেখে সব সময়ই পাশে দাঁড়িয়েছি। নিঃস্বার্থভাবে অন্যের উপকার করার চেষ্টা করেছি। যে কারণে ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আবদুস সালাম আমাকে ভালো বাসতেন। তিনিই একদিন নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। হয়ে গেলাম মেম্বার। আমি গরিব মানুষ। তারপরও এলাকার লোকজন আমাকে সম্মান করে। ভালোবাসে। কিন্তু কষ্ট পাই কেউ কিছু চাইতে আসলে যদি দিতে না পারি। তবে সাধ্যের ভিতর দিয়ে করার চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, চাউলিয়া ইউনিয়ন পৌরসভার সীমানা সংলগ্ন হলেও এলাকার মানুষের মধ্যে শিক্ষা সচেতনতার অভাব রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা বাল্য বিবাহ এবং নারীদের শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহতা। যার শিকার আমি নিজেই। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পানি নি। শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা দূরীকরণের পথে প্রতিবন্ধকতাও অনেক। এলাকার একটি বাল্য বিবাহ বন্ধ করে দিয়েছিলাম বলে একটি গ্রামের অনেক মানুষ আমার বিপক্ষে চলে গেছে। তারা আমাকে ভোট দেয়নি। কিন্তু তাই বলে থেমে যাইনি। গ্রামের প্রতিটি ঘরের মেয়েই যেনো শিক্ষিত মানুষ হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।
সাথী আকতার#
গতবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদর উপজেলার মঘি ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও অল্প ভোটে হেরে যান সাথী আকতার। কিন্তু ভেঙে পড়েন নি। থেমেও যান নি। উপরোন্তু গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিশুদের নিয়ে কাজ করেছেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্কুল বিমুখ শিশুদের বাবা-মাকে বলে স্কুলে পাঠিয়েছেন। অনেক শিশুর লেখাপড়ার খরচও যুগিয়ে থাকেন নিয়মিত। যার স্বীকৃতি মিলেছে এবারের নির্বাচনে।
সদর উপজেলার মঘি বাজারের ঔষধ ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন বিশ্বাসের স্ত্রী সাথী আকতার। অল্প বয়সেই সংসার জীবনে ঢুকে যান। কিন্তু বিয়ের পর ঠিকই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন। সংসারের প্রয়োজনে স্থানীয় একটি এনজিওতে চাকরি করলেও বেছে নিয়েছেন শিশু শিক্ষার বিভাগটি। ঝ’রে পড়া শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে গ্রামের সাধারণ পরিবারগুলোর সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছেন। যা থেকে জনসেবার জন্যে প্রতি অধিক আগ্রহ জন্মেছে। তারই ধারাবাহিকতায় নির্বাচনে অংশ নেয়া। কিন্তু ভোট চাইতে গিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেন নি। কেবল তাদের পাশে থাকার সুযোগ চেয়েছেন বলে জানান তিনি।
সাথী আকতার জানান, রাজনীতির সঙ্গে নিজের কখনও সংশ্লিষ্টতা ছিলো না। কিন্তু স্বামী ঔষধ ব্যবসার পাশাপাশি জাতীয় পার্টির একজন কর্মী ছিলেন। মানুষের অধিকার আদায় নিয়ে তিনি কাজ করতেন। যেটি ভালো লাগতো। ভবিষ্যতেও প্রথাগত নিজের রাজনীতি করার ইচ্ছে না থাকলেও কাজ করতে চান সাধারণ মানুষকে নিয়ে। নিঃস্বার্থভাবেই।
সাথী বলেন, মাগুরার অত্যন্ত অবহেলিত একটি ইউনিয়ন মঘি। শিক্ষার হারে অন্যান্য এলাকার চেয়ে এই এলাকাটি অনেকটা পিছিয়ে। এই পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নিতে চাই-এটি আমার অনেকদিনের স্বপ্ন। ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সেটি সম্ভব না হলেও নিজ প্রচেষ্টায় আমার সেই পূরণ করতে চাই।
আত্মোন্নয়নে স্বপ্ন দেখে মানুষ। আর হাসিনা-সাথী স্বপ্ন দেখেন সমাজ উন্নয়নে। গ্রামের প্রতিটি ঘর হোক আলোকিত এমন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা এই দুটি মানুষের ইচ্ছে পূরণ হোক এমন প্রত্যাশা সকলের।