অনন্যা হক: জেলা শহর মাগুরা। যখন বেড়ে উঠেছি সেই শৈশব, কৈশোর, যৌবনের দিনগুলোতে দেখেছি শহরটা ছিল ছোট্ট নিরিবিলি, পরিচ্ছন্ন এক শহর। শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের সকলে যেন ছিল সকলের চেনা। ছবির মতো পরিপাটি এক সুন্দর শহর। সেই শহরের মেয়ে আমি। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এক মাত্র সরকারি কলেজ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। সবুজ ঘাসে ঢাকা অগণিত ছাত্রছাত্রীদের কলতানে মুখরিত কলেজ ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের সেই মিষ্টি মধুর দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও উদ্বেলিত হয়ে ওঠে ভেতরটা। কত স্মৃতি! কত কথা!
কলেজ ক্যাম্পাসের মাঠটা ছিল বিশাল। চারিদিকে গড়ে তোলা ছিল একতলা, দোতলা বিল্ডিং। আর্টস বিল্ডিং, সাইন্স বিল্ডিং, আরও ছিল ছেলেদের কমন রুম, হোস্টেল। আর্টস বিল্ডিং এর নীচের তলায় ছিল টিচার্স রুম। মূল ফটক থেকে ছিল মেয়েদের কমন রুম। শ্যাওলা ধরা, চুন-বালি খসে পড়া, পুরোনো ইটের দেয়াল ঘেরা এবড়োথেবড়ো মেঝের এক রুম। বিশাল মনোরম পুকুরের একেবারে পাশ ঘেঁষে ছিল রুমটা। সেই রুমে ছিল অনাদরে পড়ে থাকা এক কাঠের টেবিল। টেবিল টাতে বসে পা দুলিয়ে জানালা দিয়ে কত দেখেছি সরগরম ক্যাম্পাসের পরিবেশ। বড় মাঠটার দিক বরাবর ছিল একটা জং ধরা রডের শিক এবং রং উঠে যাওয়া কাঠের পাল্লার জানালা ছিল। এখনও একাকী নিমগ্নতায় কতবার ঘুরে ফিরে মনে পড়ে সেই প্রিয় কলেজের কথা। ক্যাম্পাসে ছিল সবুজের অপরুপ সমারোহ। শান বাঁধানো ঘাটের পুকুর ঘিরে ছিল নারিকেল গাছের সারি। আরো ছিল অনেক বড় উঁচু জানা-অজানা গাছ, যেগুলো কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাম্পাসের মাঠে, পথে প্রান্তরে, করিডোরে, ক্লাসে পড়েছে অগণিত তরুণ, তরুণীর পদধূলি। পুকুরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সাদা মাটির পথ, সে পথেই ছিল সকলের আসা যাওয়া।
সে সময় সারা শহর জুড়ে ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবেশ, পায়ে পায়ে ছিল বিধিনিষেধের বেড়াজাল। তারই রেশ ধরে কলেজেও সেই একই পরিবেশ বিরাজ করতো। কলেজে ছিলেন অনেক শিক্ষক। অনেকেই এখন বেঁচেও নেই। বাঘা শিক্ষকদের তালিকাটাও ছিল লম্বা। ব্যক্তিত্বের ঐশ্বর্যে যাঁরা ছিলেন মূতিমান আতঙ্ক। যাদের ভয়ে ছাত্রছাত্রীরা সব সময় সংযত আচরণে চলাফেরা করতে সচেষ্ট থাকতো।
কলেজ ক্যাম্পাসে ছেলে-মেয়েদের মেলামেশা একধরনের বারণই ছিল। ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের কথা বলার সুযোগ-ই ছিল না। মনে আছে শিক্ষকদেরকে দেখে মেয়েরা কমন রুম থেকে বের হয়ে আসতো। এরপর শিক্ষকের পিছে পিছে ক্লাস রুমে যেত। আবার ক্লাস শেষ করে ঠিক একই ভাবে কমন রুমে ফিরে আসতো মেয়েরা। এটাই ছিল তখন
কলেজের বাঁধাধরা নিয়ম। এসবের ফাঁকফোকর খুঁজে ছেলে-মেয়েরা হয়ত কদাচিৎ কথা বলার চেষ্টা করতো। আমরা এভাবে মাঠের শেষ প্রান্তে সাইন্স বিল্ডিং-এ ক্লাস করতে যেতাম। একেবারে পিনপতন নীরব পরিবেশে ক্লাস হতো। ক্লাস বা করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো উপায় ছিল না। তবে ক্লাসের ফাঁকে এর ওর ঘাড়, মাথার পাশ কাটিয়ে অনেকেরই দৃষ্টি বিনিময় হতো। দেখা যেত অনেক কৌতুহলী, উৎসুক দৃষ্টি। সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছিল। শিক্ষকের পেছনে ফিরতে ফিরতে মেয়েদের কানে আসতো ছেলেদের নানা ধরনের টিপ্পনী, তির্যক কথা, মন ভোলানো কথা। তখন ঐ বয়সে সবই যেন অকারণে, অহেতুক ভাল লাগতো। কলেজে পড়ার বয়সটাই ছিল ভীষণ উচ্ছ্বলতার। ছেলেরা যেন মেয়েদের উচ্ছ্বলতাকে উস্কে দিয়ে মজা পেত।
কমন রুমে ফিরে এসে মেয়েদের হাসি, আড্ডার জোয়ার উঠতো। ক্লাসের কোন টিচার কেমন করে কথা বলেন, কোন ছেলেটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, কে বোকা, কে ফাজিল, কেমন করে হাঁটে, বেঞ্চে প্লাস, মাইনাস সংকেত বা অঙ্কের থিওরি দিয়ে কি সব লেখা থাকে, সবই উঠে আসতো আড্ডার বিষয়বস্তুতে। তখন ছেলে আর মেয়েরা যেন ছিল কোনো ভীনগ্রহের বাসিন্দা। কমন রুমে ইনডোর্স গেইম-এর বিভিন্ন আয়োজন থাকতো। মাঝে মাঝে কিছু সাহসী অতি উৎসাহী যুবক শিক্ষকদের দৃষ্টির এড়িয়ে মেয়েদের কমন রুমের বারান্দায় এসে কারো সাথে কথা বলে চলে যেত।
আমাদের ছেলে সহপাঠীদের আমরা দূর থেকেই যতদূর চিনতাম, সেটা ছিল শুধুই মুখ চেনা।আর মেয়ে সহপাঠীর মধ্যে যাদের সাথে আন্তরিক ছিলাম, কলেজ জীবনের বেশ খানিকটা মধুর সময় ব্যয় করেছি, তাদের নাম এখানে না বললেই নয়। যারা স্মৃতির পাতায় যখন তখন উঁকি দেয়, যাদের কাছে গিয়ে এখনও তেমনই উচ্ছ্বল হয়ে গল্প করতে মন চায়। তাদের মধ্যে অন্যতম সঞ্চিতা, শারমিন, বাবলি,পলি,স্বপ্না,আর্নিকা, বিউটি এমন কয়েক জন। মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম ছিল।একটু গর্ব করে বলতে ইচ্ছে করে, আমাদের ৮১/৮২ ব্যাচের ছাত্র ছাত্রীদের এইস এসসির রেজাল্ট বেশ ভাল হয়েছিল। ভাল ফলাফলের তালিকাটা বেশ বড় ছিল। পরবর্তীতে তারা দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নের সুযোগ করতে পেরেছিল। আমরা ছিলাম বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। তখন আমাদের সমসাময়িক ছোট বড় দিয়ে কলা বিভাগে মেয়েদের সংখ্যা ছিল বেশি। যাদের মধ্যে ভীষণ মনে পড়ে- লাকি আপা, বলাকা আপা, মেরী আপা, যমুনা আপা, কাকলি, ডেলি,আন্জু, শিউলিসহ আরো এমন অনেকের কথা।জীবন সংসারের তাগিদে এখন সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু যখন আমার নিরিবিলি অবসরে কলেজ ক্যাম্পাস চোখে ভাসে, আমি এক সাথে দেখতে পাই সেই সব পরিচিত প্রি মুখগুলোকে, যেন চোখের সামনে হেঁটে বেড়াচ্ছে কলেজের এ প্রান্তে ও প্রান্তে। কি জমজমাট সেই দিন, সেই সব ক্ষণগুলো। জানি ফিরবে না আর কখনও, তবুও নিভৃতে ফিরে আসে আমার মানসপটে।
আমার বাবা মো. মাহফুজুল হক (যিনি নিরো প্রফেসর নামে খ্যাত) ছিলেন মাগুরা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। তিনি তখন কলেজের বাঘা টিচার হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে নমস্য। মনে পড়ে না তখন কলেজ ক্যাম্পাসে কারো সাথে কখনও কথা বলেছি। রাশভারী, রাগী বাবার ভয়ে কমন রুমের বারান্দায় বেরিয়েছি কম। রক্ষণশীলতার একটা আলাদা মজা আছে স্বীকার না করে উপায় নেই। সেখানে সব কিছু ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে বলে অনুভব থাকে অনেক গভীরে, আর আকর্ষণ থাকে তীব্র। সকালে উঠে ব্যতিব্যস্ত থাকতাম, কখন পরিপাটি হয়ে কলেজে যাব। দেখতাম ছাত্র-ছাত্রীরা কাছে দূরে থেকে কেউ আসতো হেঁটে, সাইকেল, রিকশা, ভ্যানে বা বাসে চেপে। কলেজে সাইকেল রাখার জন্য একটা স্ট্যান্ডও ছিল। সারি সারি সাইকেল রাখা থাকতো স্টান্ডে। কলেজ শেষে দূরের শিক্ষার্থীরা চলে যেতো সাইকেল চালিয়ে।
রক্ষণশীল সমাজ, পাছে লোকে কিছু বলে, পায়ে পায়ে বাঁধা ছিল বলে কলেজ ক্যাম্পাসের আকর্ষণ তীব্র ছিল। শহরের কলেজ ক্যাম্পাসই ছিল ছেলেমেয়েদের একত্রিত হবার একমাত্র মিলনমেলা। এখানে কত তরুণ তরুণীর চোখে চোখে কথা হয়ে হতো হ্নদয়ের হাতছানি। এরপর পরিচয় থেকে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়েছে কত জুটি তার হিসেব কে রাখে!
কলেজ ক্যাম্পাস এখন ঠিক আগের মতো নেই। সময়ের চাহিদায় গড়ে উঠেছে আরো নিত্যনতুন বিল্ডিং, ভেতরের পরিসরে এসেছে পরিবর্তন, পরিবেশে এসেছে অনেক বিবর্তন। তবে এটাই সত্য প্রিয় মাগুরা কলেজ ক্যাম্পাস বুকে ধারণ করে রেখেছে কত না হাজার স্মৃতি। এই কলেজের কত শিক্ষার্থী দেশ বিদেশের কত না জায়গায় ছড়িয়ে আছে! আবার কত ছাত্র, শিক্ষক চিরতরে হারিয়ে গেছেন। প্রিয় কলেজ ক্যাম্পাস দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
আমাদের মানসপটে কলেজ মানেই ভেসে ওঠে বহু চেনা মুখের ভীড়ে স্মৃতি বিজড়িত সেই মুখরিত রপময় ক্যাম্পাস। এখনও টানে যেন কোনো এক দুর্ণিবার আকর্ষণে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কোনো এক স্নিগ্ধ সকালে, সেই সময়ে, সেই জীবনে, আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে! যেখানে এখনও ভোরের দোয়েল শীস দেয়, হলুদ পাখি ওড়াওড়ি করে।
অনন্যা হক: কবি-লেখিকা, মাগুরা সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।