মাগুরা প্রতিদিন ডটকম : ৭ ডিসেম্বর মাগুরা মুক্ত দিবস। একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশের আরো কিছু জেলার সাথে মাগুরাও হানাদার মুক্ত হয়। শত্রুমুক্ত হওয়ার আনন্দে এদিন সারা শহরে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নামে। ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা শহর। দিবসটি পালনে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মাগুরা জেলার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাগুরার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। ২ মার্চ শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে তৎকালীন কোর্ট চত্ত¡রের সামনে বটতলায় (বর্তমানে পুলিশ সুপারের কার্যালয়) তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম আগুনঝরা বিপ্লবি বক্তব্য রাখেন। এ ঘটনায় মাগুরার মানুষের মাঝে ব্যাপক উদ্দিপনার সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে স্থানীয় মুক্তিকামি মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। তৎকালিন মহকুমা ছাত্রলীগ সভাপতি মুন্সি রেজাউল ইসলামের নেতেৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং এড. আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক ও ওয়ালিউল ইসলামকে সদস্য সচিব করে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। পরবর্তীতে এ দুটি পরিষদ ঢাকার ঘোষণা অনুযায়ী মাগুরাতেও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে এবং ৩ মার্চ মাগুরায় সফল হরতাল পালন করে।
সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান অন্যতম দুই উপদেষ্টা সৈয়দ আতর আলী এবং এড. সোহরাব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এ অসহযোগ আন্দোলন অব্যহত রাখেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গেরিলা তৎপরতা চালাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এড.আবুল খায়ের, আলতাফ হোসেন, নবুয়ত মোল্যা, রোস্তম আলী, আবু নাসের বাবলু, নন্দ দুলাল বংশী প্রমুখ।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সারা দেশে হত্যযজ্ঞ শুরু করলেও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ২৬ মার্চ পর্যন্ত মাগুরার প্রবেশ পথ গুলোতে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে এক কঠিন প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরী করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি তারা স্থানীয় ভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ, অস্ত্র ও সদস্য সংগ্রহ করতে থাকে।
১২ মার্চ তারা ঝিনাইদহ এসডিপিও মাহবুবের সহযোগিতায় মাগুরা থানা লুট করে বেশ কয়েকটি অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। অন্যদিকে ২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গা ইপিআর এর ৪ নং উইং কমান্ডার মেজর ওসমান বিদ্রোহ ঘোষণা করে ১ প্লাটুন সদস্যকে অস্ত্রসহ মাগুরার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগ দিতে পাঠিয়ে দেন যা পরবর্তীতে ব্যপক সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
সংগ্রাম পরিষদ মাগুরা নোমানী ময়দানস্থ আনসার ক্যাম্পের টিনের ঘরটিকে তাদের প্রধান কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণেচ্ছু ছাত্র জনাতাকে সংঘটিত করে নোমানী ময়দান, পারনান্দুয়ালী শেখপাড়া আমবাগান, ওয়াপদা, সদর উপজেলার কাটাখালী ব্রিজের পাশেসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় হাবিলদার সাজাহান, কামরুজ্জামান (শৈলকুপা), হারেসার, জাহিদুল ইসলাম মিটুল, আকবর হোসেন, জাহিদুল ইসলাম (বেলনগর), আঃ ওয়াহেদ মিয়া (পারনান্দুয়ালী), আবদুল মান্নান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
৪ এপ্রিল তাজুদ্দিন আহম্মেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম মাগুরার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয় এবং ঐদিন রাতে সংগ্রাম পরিষদ তাদেরকে মাগুরা থেকে ভারতের পথে এগিয়ে দিয়ে আসে। এ দিনেই মাগুরা-যশোর সড়কের লেবু তলায় পাক বাহিনীর সাথে সুবেদার মুকিতের নেতৃত্বে মাগুরা সংগ্রাম পরিষদের ব্যপক সম্মুখ যুদ্ধের সৃষ্টি হয় যা ৭ এপ্রিল পর্যন্ত দফায় দফায় চলতে থাকে।
এদিকে ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে শপথ গ্রহণের পর মাগুরার সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ রানাঘাটে দায়িত্ব পালনের জন্য ভারত গমন করেন। অন্যদিকে ২২ এপ্রিল সোমবার দুপুরে পাক সেনাবাহিনী বিশাল ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে ঝিনাইদহ ও যশোর সড়ক দিয়ে মাগুরা সীমানায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এদিন মাগুরার আলমখালী বাজার এলাকায় সুরেন বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তিকে পাক সেনারা গুলিতে নিহত করে এবং পরদিন ২৩শে এপ্রিল মঙ্গলবার জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়ায় পাক সেনাবাহিনী বাগবাড়িয়া গ্রামের লালু নামে এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে হানাদাররা শহরের পিটিআই, ভিটিআই, সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ) চত্ত¡র, মাগুরা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নিউ কোর্ট বিল্ডিং, মাইক্রোওয়েভ স্টেশন ও মাগুরা সরকারি কলেজে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। শহরের মধুমতি ডাক বাংলোটিকে তারা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। পাক বাহিনী স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিত করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে তাদের যোগসাজসে নারকীয় হত্যাযজ্ঞসহ বর্বর হামলা আক্রমন চালিয়ে যেতে থাকে। মেজর হায়াত এবং মাগুরার রিজু, কবির, পীর ওবায়দুল্লাহ, বাশি চেয়ারম্যান ও আয়ুব চৌধুরীদের সেই সময়কার পৈচাশিক হত্যযজ্ঞ ও বিভিষিকার কথা মাগুরার মানুষের মনে এখনো জ্বলজ্বল করে।
তবে মুক্তিযুদ্ধের এই সময়কাল জুড়েই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মূলত গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে পাকবাহিনীতে ব্যাতিব্যস্ত ও তটস্থ করে রেখেছে। যে ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শ্রীপুরের আকবর বাহিনী, মহম্মদপুরের ইয়াকুব বাহিনী, মাগুরা শহরের খোন্দকার মাজেদ বাহিনী এবং মুজিব বাহিনী বিশেষ সাহসী ভুমিকা রাখে।
শ্রীপুরের শ্রীকোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শ্রীপুর বাহিনী মূলত মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর এলাকা জুড়ে তৎপরতা চালায়। এ বাহিনীর অব্যাহত অভিযান ও স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর তৎপরতায় পাক বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। ৬ ডিসেম্বর মাগুরাকে হানাদার মুক্ত করতে নিজনান্দুয়ালি গ্রামে ও বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্পে তারা আক্রমন চালায়। একই সাথে মিত্র বাহিনীর আগ্রাসনের ভয়ে পাকিস্তানী সেনারা রাতারাতি মাগুরা শহরে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরদিন ৭ ডিসেম্বর মাগুরা হয় শত্রুমুক্ত। মুক্তির আনন্দে সারা শহরে নামে হাজারো মানুষের ঢল।
মাগুরায় প্রতিবছরই ৭ ডিসেম্বরকে হানাদার মুক্ত দিবস ধরে বিশেষ উৎসাহ নিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবারো দিবসটি উপলক্ষে মাগুরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।