আসমা মিলি : মানব শিশু দুনিয়ার আলো দেখে মা বাবার অপরিসীম ত্যাগ, কষ্টের মাধ্যমে। বাবা মা নিজের সুখ আনন্দ বিসর্জন দিয়ে সন্তান লালন পালন করেন। সন্তানের সুখেই সুখী হোন। সন্তানের সাবলম্বী হবার পূর্ব পর্যন্ত সকল প্রয়োজন মেটান। নিজের সামর্থ্যের অতিরিক্ত দিয়ে বড় করেন সন্তানকে। লিখাপড়া শেখান ভালো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। সন্তানকে বড় করতে ভিটা বাড়ী বিক্রী করেও দেশে বিদেশে পড়তে পাঠান। পরে নিজের ঠাই হয় বৃদ্ধাশ্রমে নয় তো আত্মীয় পরিজনের দয়ার আশ্রয়ে।
সন্তানের জীবনে পুর্ণতা এনে দিতে তাকে বিয়ে দেন, সেখানেও সন্তানের আব্দার নিরবে পূরন করেন। কখনো সন্তানের প্রত্যাশা অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকতা করতে গিয়ে সর্ব শান্ত হন। তবু ও দুঃখ কিংবা আফসোস করেন না। সন্তানের জন্য নিজেকে নিঃশ্বেষ করে দিতে পারেন কেবল বাবা মা’ই। তাতেও সন্তানের মন ভরাতে পারেন না। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে উঠেন বাবা মা।
তখন সন্তান তাদের স্ত্রী কিংবা স্বামীর খুশির জন্য বাবা মাকে ত্যাগ করে। তাদের স্ত্রী সন্তানের আরাম আয়েশের জন্য বাবা মার যায়গা হয় স্টোর রুমে, কখনো ছোট্ট গেস্ট রুমে, কখনো পোষা ময়নার রুমে, বা পোষা কুকুর বিড়ালের রুমে।
কোন এক সন্তান তার অসুস্হ বাবাকে স্ত্রী শিশু সন্তানদের আরাম আয়েশ নিশ্চিত করতে স্টোর রুম টাইপের পোষা ময়নার রুমে রাখার ঘটনাও দেখেছি। সংসার টিকিয়ে রাখা কিংবা সংসারের শান্তি বজায়ে রাখার জন্য বাবা মাকে অবহেলা করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।
ছেলেরা বউকে খুশী করতে বাবা মাকে কষ্ট দেয়, মেয়েরা স্বামী খুশী রাখতে বাবা মার দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। আফসোস এ সকল সন্তানদের জন্য। যে সকল মেয়েরা স্বামীর উপর নির্ভরশীল তারা নিজের এবং স্বামীর পিতামাতার প্রতি দায়িত্বহীন থাকেন। অধিকাংশ আবার নিজের বাবা মার প্রতি অতি দায়িত্বশীল হতে গিয়ে শ্বশুর শাশুড়িকে বঞ্চিত করেন।
ঢাকায় কিংবা বড় শহরে ছেলে মেয়েরা প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরী করেন স্ত্রী, স্বামী, সন্তানদের জন্য। সেখানেও বাবা মার যায়গা হয় না। গ্রামের গনগনে গরম টিনের কুটিরে কোন রকমে কেটে যাচ্ছে বাবা মার জীবন। তাদের সন্তানেরা দাদা বাড়ি যায় না। কারন যাবার মত ব্যবস্হা সেখানে নেই। দাদার জীর্ন বাড়ি থাকলেও বাবার বাড়ি নেই। আধুনিক সুবিধা সম্বলিত আরাম আয়েশ তো নেই ই।
এ সকল ছেলেদের মেয়েদের একবারও মনে হয় না, নিজে শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ঘুমাচ্ছে অথচ বাবা মা লোড শেডিং এ হাত পাখা চালিয়ে ছটফট করছে। কিন্তু ধর্মকর্মে মনোযোগী এ সকল পুত্র কন্যা, জামাতা, পুত্রবধূ, নাতি নাতনী সকলেই জানে, ” মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত।” নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত কোনটাই বাদ দেয় না এরা। শুধু জানে না পিতা মাতার প্রতি সন্তানের প্রকৃত দায়িত্ব কর্তব্য কী? পিতামাতার হক কী?
এক মহতি নারীর জীবনের গল্প থেকে জেনেছি, বড়লোক শিক্ষিত শাশুড়ি বিয়ের পর তাকে ঠিকমত খেতেও দিতেন না। অত্যাচার করেছেন নানাভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বউকেও তিনি মানতে পারেন নি। কিন্তু তাই বলে শাশুড়ি যখন অসুস্হ হয়ে শয্যা নেন তখন কিন্তু বউমা তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাননি। মৃত্যু পর্যন্ত সেবা করেছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ খারাপ ব্যবহার করলে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নিজেকে উত্তম ভাবা যায় না। অধমের খাতায় নাম লিখাতে হয়।
আজকালকার অধিকাংশ শিশুদের নানা নানীর প্রতি মায়া থাকলেও দাদা দাদীর প্রতি মায়া থাকে না। তার অন্যতম কারণ বউ শাশুড়ির টানাপোড়েন। ছেলের বউরা কখনোই শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি সহানুভূতিশীল হয় না। কেউ কেউ ঠ্যাকায় পড়ে দায়িত্ব পালন করে। অল্প স্বল্প আবার দায়িত্ববোধ কিংবা ভালোবেসেও করে। কিন্তু না করার দল ভারি। যে কারণে দাদা দাদী যে শিশুর অনেক আপনজন তা মায়েরা সন্তানদের শেখায় না। বরং প্রতিপক্ষ মনে করতে শেখায়।
সন্তানের নির্ভরতার সম্পর্ক শুধু বাবা মা নয়, রক্তসম্পর্কীয় আরো কিছু বন্ধন থাকে যাদের থেকে শিশুদের দুরে রাখা হয়। দাদীর সম্পর্কে খারাপ কথা শুনে বেড়ে উঠে শিশুরা। তাই দাদী নামক মানুষটাকে বড় হবার পর অপছন্দ করে তারা। অথচ একবারও ভাবে না তাদের প্রিয় বাবার “মা” তাদের মায়ের মতই তাদের বাবাকে ভালোবাসে।
সন্তানকে তারা পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, আদর যত্নে বড় করেছেন। বাবা মার সব কিছুতে যেমন সন্তানের অধিকার থাকে তেমনি সন্তানের সব কিছুতে মা বাবার অধিকার আছে। এটা যদি সন্তানেরা মনে রাখে তাহলে কোন বাবা মার জন্য বৃদ্ধাশ্রম তৈরী হবে না। কোন বাবা মা চোখের জলে সন্তানকে স্মরন করবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে না ভালো থাক প্রিয় সন্তানেরা।
জীবনের এতো ক্ষুদ্র সময় টুকু হিংসা, স্বার্থপরতা, কলহ, কপটতা নিয়ে নষ্ট করে কেউ নিজেকে লাভবান করতে পেরেছে কি না জানি না। তবে নিজের ক্ষতিই ডেকে আনে হয়তো। মনের বিশালতায়, ক্ষমার উদারতায় আর গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধায় ছোট্ট জীবনটাকে আরো সুন্দর আরো শান্তির করে তোলা যায়। শুধু প্রযোজন একটু সদিচ্ছা।
আসমা মিলি: লেখিকা, সাবেক পুলিশ সুপার, রাজবাড়ী।