আমি একবার নীচতলায় গিয়ে আব্বাকে দেখলাম ভালো করে। একটু পরই উঠে এলাম উপরে। একা একা একটু শুয়ে থাকব ভেবেছিলাম। কিন্তু পারিনি। একে একে বন্ধুরা উপরে আসতে লাগলো দেখা করতে। বুঝতে পারছি নীচতলা ভরে গেছে প্রিয়জনে। এমনই তো হওয়ার কথা। ফেসবুকের যুগ। মুহূর্তেই ছড়িয়ে যাচ্ছে খবরটা। যথারীতি কণ্ঠবীথির ছেলেরা সব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ফেলেছে। আমার কোন কাজ নেই তেমন। একটার পর একটা ফোন আসছে কিন্তু ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বারবার মনে হচ্ছে শেষ হয়ে গেলো একটা অধ্যায়।
আমার বাবা কে ছিলেন তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। যারা আমার লেখাটি পড়ছেন তারা আমার বাবাকেও জানেন ভালো করে। ৯৫ বছরের একজন মানুষের মৃত্যু কতটুকু আর শোকের হতে পারে। তাও যদি হয় সফল একজন মানুষের মৃত্যু । হ্যাঁ, সফলই বলব আমি। কেননা বাবার কাছ থেকে শিখেছি সফলতার সংজ্ঞা। যে সংজ্ঞা সচরাচর সংজ্ঞার সাথে মেলে না। বড় চাকরি, বড় ব্যবসা, বড় ক্ষমতা এসব সফলতাকে আব্বা কখনো সফলতা বলে ভাবেননি। তাইতো তাঁর জীবনী খুলে দেখি, বারবার বড় বড় সরকারি চাকরি ছেড়ে এলাকায় ফেরা। একটার পর একটা প্রতিষ্ঠান গড়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন তিনি। হেরে যাননি কোথাও। আজীবন ব্যস্ততা। এর মধ্যেই শরীরের যত্ন। সীমিত আহার। নিয়ম মাফিক ঘুম। নিয়ম করে পড়াশোনা। এভাবেই ৯৫ বছর নিজেকে সুস্থ রেখে নিরলস কাজ করে গেছেন তিনি।
আব্বার মরদেহের পায়ের কাছে বসে অসংখ্য মানুষকে কাঁদতে দেখেছি। তাদের অনেককেই চিনি না। অনেকে এসেছেন দূর দূরান্ত থেকে। এক নজর দেখবেন তার প্রিয় শিক্ষককে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতি কর্মী, স্কাউটস, খেলোয়াড়, দোকান মালিক, শ্রমিক সবাই বলছেন স্যার আমাকে খুব ভালো বাসতেন। জানিনা, একটা মানুষ কিভাবে একসাথে এতজনকে ভালো বাসতে পারেন।
আব্বার যে কোন কষ্ট ছিলো না তা বলব না। কিন্তু কষ্ট গুলো তিনি বুঝতে দেননি কাউকে। শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। আগেই বলেছি সফলতার সংজ্ঞা আব্বার কাছে অন্য রকম। জীবনভর উদ্যম নিয়ে কাজ করতে পারাই সফলতা। মাগুরার প্রতিষ্ঠিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে খান জিয়াউল হক ছাড়া মাগুরার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। কর্মবীর এই মানুষটি কাজকেই গ্রহণ করেছেন সবচেয়ে বড় করে। মৃত্যুর আগেরদিন পর্যন্ত মিটিংয়ে গেছেন। মৃত্যু হয়েছে ঘুমের মাঝেই। হাজারো মানুষের ভালোবাসায় বিদায় নিয়েছেন। এ যেন এক বীরের জীবন যুদ্ধ জয় করে হাসতে হাসতে বিদায় নেওয়া।