সুলতানা কাকলি : “ঘাট অঘাট হবে, মূর্খরা বিচারকের আসনে বসবে, ছেলেরা ঘোড়ার মতন চুল কাটবে, ছোটরা বড়দের সম্মান করবেনা। প্রতিবেশীরা কেউ কারো খোঁজ নেবে না, ওজনে কম দেবে, খাদ্য বস্তু থেকে আস্তে আস্তে স্বাদ, গন্ধ উঠে যেতে থাকবে, গরম কালে শীত, শীত কালে গরম, লু হাওয়াতে যখন কণ্ঠতালু শুকিয়ে যাবে তখন নির্ঘাত বুঝে নেবে কেয়ামত খুব সন্নিকটে।”
এই কথা গুলো আমাদের প্রতিবেশী একজন ভদ্র লোক যখনই সুযোগ পেতেন তখন আমায় বলতেন। তিনি নম্র স্বরে কথা বলতেন আর নানান রকম উপদেশ আমায় দিতেন। যখনই সুযোগ পেতাম তাঁর কাছে বই খাতা নিয়ে চলে যেতাম-অংক, ইংরেজি, বাংলা, যেকোন বিষয় তাঁর কাছে নস্যি। স্কুলের শিক্ষকদের চাইতে নিঃসন্দেহে তিনি অনেক ভাল পড়াতেন। শিক্ষক হলে হয়তো তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের এওয়ার্ড পেতেন। কিন্তু ছাত্রদের দূর্ভাগ্য যে, তাঁর মতো জ্ঞানী মানুষের সঙ্গ লাভ হতে বঞ্চিত হতে হয়েছে। আমি কৈশরে বেণী দুলিয়ে তাঁর কাছে পড়তে যেতাম। তিনি বলতেন,”মারে! এমন ভাবে পড়বি যেন সব হজম করে ফেলবি। আর পরীক্ষার খাতায় এমন ভাবে লিখবি যেন বমি করার মত উগরে দিবি।
জীবন সায়াহ্নে এসে তাঁর কথাগুলো খুব মনে পড়ে। যেদিকে দৃষ্টি যায় তাঁর কথাগুলো মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। রাস্তায় বেরুলেই দেখি সারিবদ্ধ উঠতি বয়সী ছেলেরা ঘাড় ও কানের দুপাশ থেকে চুল গুলো ছিলে শুধু চান্দির উপর ফেন্সী করে একগুচ্ছ চুল ঘোড়া ছাট মেরে সগৌরবে হাসি-তামাসা করতে করতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পাশ দিয়ে কে যাচ্ছে, কে আসছে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কোন কোন ছেলেদের দেখলাম, চুলে ক্লিপ সাটানো ও মেয়েদের মতন চুল কালার করা। দেখলেই মেজাজটা টং হয়ে যায়। সেদিন মোবাইলের উপরে কাঁচ লাগাতে যেয়ে দেখি মেকানিক ছেলেটার এক কানের লতিতে দুল আটকানো। শরীরে এক চিমটে গোস্ত ছাড়া কিছুই নেই। চোপরা দুটো ভাঙা, সরু দু’ঠ্যাঙে রং চটা জিন্স পরা। মানুষ না হলে বান্দর হলেই মানাতো বেশি। বেশ-ভূষাতেই বুঝলাম কুত্তার ছাল নেই নাম তার বাঘা। ঘাট গুলো সব অঘাট হচ্ছে। এসব দেখার কেউ নাই? এদের বাবা-মাও বোধ হয় ওদের কাছে জিম্মি। বিভিন্ন খবর ভেসে ওঠে-পাবজি, ফ্রি ফায়ার খেলার জন্য পঞ্চাশ টাকা না দেওয়ায় ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে। মাগুরার মহম্মদপুরে ডিম বিক্রেতার ছেলে আত্মহত্যা করেছে মোটরবাইক কিনে দেয়নি বলে। আজব সব কান্ড কারখানা। টিকটক বেহায়াপনা এর আড়ালে নারী পাচার, ধর্ষণ, নগ্ন করে ভিডিও করে নেটে ছড়িয়ে দেয়া। বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর ও যুব সমাজ। বিভিন্ন এলাকাতে কিশোর গ্যাঙের উৎপাত, চাঁদাবাজি খুনখারাপি, সবাই বল্গাহীন ঘোড়ার মত ছুটছে ক্রাইমের দিকে। টপ টু বটম যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে অনাচার করার জন্য। দুনিয়া যাচ্ছে কোন দিকে ভেবে শংকিত হই।
কৈশরের সেই দিনগুলোর কথা বার বার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। নষ্টালজিক হয়ে পড়ি। স্কুল ড্রেস পরে বেণী দুলিয়ে হেটে যেতাম। দৃপ্ত, নিঃসঙ্কোচ পদগমনে স্কুল পানে আমরা কজনা! এখনকার মত কখনও রাস্তায় ছেলেদের বাজে কমেন্ট শুনে অপ্রস্তুত হইনি। ছেলেরা সমীহ ভাব নিয়ে মাথা নীচু করে পাশ কেটে চলে গেছে্। হয়ত একটু আড় চোখে তাকালেও তাদের দু’চোখ মুখের উপরেই থেকেছে, তার নীচে নামেনি কখনও। আর এখন! এক সাথে ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলা মেশায় সমাজ এগিয়ে যাবার বদলে যেন কলুষতার বিষ বাষ্পে নিপতিত হচ্ছে, বাবা-মায়ের অবর্তমানে রুদ্ধ ঘরে শরীরের এক্সপেরিমেন্টের খেলায় বান্ধবীর মৃত্যুর মত অসংখ ঘটনা ঘটছে।
মফস্বল শহরে কো-এডুকেশন কলেজে আমরা মেয়ে ও ছেলেরা একসাথে পড়েছি।বান্ধবীরা ভার্সিটিতে পড়েছে, কই! তখন তো এত নগ্নতা, বেলেল্লাপনা, ছেলে বন্ধুদের সাথে নেশায় বুঁদ হয়ে থেকে জীবনটাকে অনিশ্চয়তার দিকে কখনও কেউ ঠেলে দেয়নি। বরং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতার মধ্যে আমরা দিন কাটিয়েছি।
আশির দশকে আমার কলেজ জীবনের কথা খুব মনে পড়ে। ক্লাস শেষ হলেই দলবদ্ধ হয়ে মেয়েরা সব কমনরুমে চলে আসতাম। অফ পিরিয়ডে এক সাথে সবাই আড্ডা দিতাম, কেউ দাবা খেলতো, কেউ ক্যারাম খেলতো। তখন ছাত্ররা রাজনৈতিক ভাবে খুবই সক্রিয় ছিলো। প্রতিদিন কলেজে প্রতিটি দলের মিছিল, মিটিং চলতেই থাকতো। সব ছেলেদের মাথা গরম হয়ে থাকতো। ভয়ে কেউ কারো ধারে যেতে সাহস করতোনা। এই বুঝি মারামারি, গন্ডগোল লাগলো। একদম থমথমে পরিবেশের মূহুর্তেই আমরা মেয়েরা ওদের আচরণের জন্য কখনও ভীত হইনি। বরং ওরা কমনরুমের সামনে এসে আমাদের সাবধানে থাকতে বলতো। ভার্সিটিতে পড়ুয়া বান্ধবীদের কাছে শুনেছি স্বৈরাচারী সরকার যখন তখন হল বন্ধ করে দিতো। এমনকি মধ্য রাতেও মেয়েদের হল খালি করে দিতে হয়েছে। এদিকে হরতালের জন্য সকল পরিবহন বন্ধ, মেয়েরা মধ্যরাতে ব্যাগ হাতে নিয়ে হোষ্টেল ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে আর ছেলে সহপাঠীরা পুলিশের গুলি, টিয়ারগ্যাস উপেক্ষা করে মেয়েদের নিরাপদ দুরত্বে সাথেকরে বড় ভাইয়ের মত হাত ধরে নিয়ে গেছে।
আর এখন❓যুব সমাজ এত অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে যে সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে খুবই শংকিত। শুধু সমাজের অবক্ষয় নয়-পরিবেশ, প্রকৃতি যেন ক্রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ফুসে উঠেছে। প্রচন্ড তাপদহ, এর মধ্যে, ফনি, যশ, আম্পান, করোনা, আবার কি ফাঙ্গাস এসে আমাদের জীবনে রোজ কেয়ামত এনে দিচ্ছে।
ছয়টি ঋতু কোথায় হারালো জানিনা!
কেয়ামত কবে হবে তাও জানিনা, তবে রাস্তায় বেরুলে যুব সমাজের অবক্ষয়, দিয়ে লুটপাটের মহোৎসব দেখে মনে হয় কেয়ামতের মধ্য দিয়েই বোধ হয় আমরা হাঁটছি।