মাগুরা প্রতিদিন ডটকম : করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ শিল্পীদের আর্থিক অনুদানের নামে মাগুরা জেলা শিল্পকলা একাডেমি সংশ্লিষ্ট একটি গোষ্ঠি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের প্রায় অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ইন্ডিয়াতে বসবাসরত পরিবার, মাগুরায় কয়েক কোটি টাকার অর্থ বিত্তের মালিক, জীবনে কখনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না এমন সহ অসংখ্য ভূয়া ও অযোগ্য ব্যক্তিদের নামে মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা করে বরাদ্দকৃত চেক তারা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মাগুরা জেলা শিল্পকলা একাডেমি’র কালচারাল অফিসার জসিম উদ্দিন, শিল্পকলা পরিচালনা পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত চক্রবর্তি এবং সঙ্গীত শিক্ষক অজিত রায় সহ আরও বেশ কয়েকজন যোগসাজসে নিজেদের পরিবারের সদস্যদের নামে বরাদ্দের পাশাপাশি নামে-বেনামে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের এই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীদের অভিযোগ।
তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা গেছে, গত ১৯ মার্চ মাগুরা আছাদুজ্জামান মিলনায়তনে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪ শত ৩৮ জনের নামে চেক বরাদ্দ দেয়া হয়। এ অনুষ্ঠানে অল্প সংখ্যক ব্যক্তিদের মধ্যে চেক বিতরণ করা হলেও অধিকাংশ ব্যাক্তির নামে ইস্যুকৃত চেক তুলে নেন ওই গোষ্ঠির সদস্যরা।
অভিযুক্ত গোষ্ঠি নির্বাচিত তালিকা থেকে দেখা গেছে, জেলা শিল্পকলা একাডেমি’র পরিচালনা পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত চক্রবর্তির বোন বিথি চ্যাটার্জি এবং তার স্বামী আনন্দ চট্টোপাধ্যায়ের নামে দুটি চেক ইস্যু করা হয়েছে। অথচ তারা গত এক বছর যাবত ইণ্ডিয়াতে বসবাস করছেন। এছাড়াও তার পরিবারের আরও অন্তত ১৪ জনের নাম রয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যাদের কখনই সংশ্লিষ্ট দেখা যায়নি।
তালিকার ২২৯ নং ক্রমিকে পবিত্র কুমার চক্রবর্তী নামে স্থানীয় একটি কাপড়ের দোকানের সেলসম্যানকে নাট্যশিল্পী হিসেবে দেখানো হলেও তিনি জীবনে কোনদিন নাটকের স্টেজে উঠেছেন বলে শহরের কেউই জানেন না। তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমির সহ-সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর ভগ্নিপতি।
একইভাবে ২৩০ নং ক্রমিকে ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী বিশ্বজিতের ভাইপো, ২৫৫ ক্রমিকে বরুন চক্রবর্তী বড়ভাই, ২৫৬ ইতি চক্রবর্তী ছোটবোন, ২৬৪ প্রনয় চক্রবর্তী ভাগ্নে, ২৬৫ প্রিয়াংকা চক্রবর্তী ভাগ্নি, ২৬৬ গোপাল চক্রবর্তী চাচাতো ভাই, ২৬৭ বন্দনা চক্রবর্তী ভাইয়ের বৌ, ২৬৮ প্রদীপ চক্রবর্তী চাচতো ভাই এর ছেলে, ২৭০ কার্তীক চক্রবর্তী চাচতো ভাইয়ের ছেলে, ২৭১ সুদীপ্ত চক্রবর্তী ভাতিজা, ২৭২ আনন্দ চক্রবর্তী ভগ্নিপতি, ২৭৪ বিথি চক্রবর্তী ছোট বোন, ২৫৭ নং ক্রমিকে ছবি রানী ভট্টাচার্য ভাইয়ের স্ত্রী।
শুধু তাই নয়, শহরের কেশব মোড়ের বাসিন্দা বর্তমানে স্বামীর কর্মস্থল ঢাকায় অবস্থানরত স্নিগ্ধা পাল নামে এক সাবেক নৃত্য শিল্পী ও তার মায়ের নামে ১০ হাজার করে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কাস্টমস বিভাগে কর্মরত জনৈক ব্যক্তির স্ত্রী স্নিগ্ধা পালের মাগুরা শহরে ২টি ফ্লাট, ১টি বাড়ি ও একটি বিশাল বাগান বাড়ি রয়েছে। যার মূল্যমান কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তাকে ও তার মা জোসনা পালকে ১০ হাজার করে দুটি চেক দেয়া হয়েছে।
মাগুরা শিল্পকলা একাডেমির সংগীত শিক্ষক অজিত রায় শহরের সাতদোহা পাড়ার একই পরিবারের সন্ধ্যা রানী ঘোষ (ক্রমিক নং-৪১৯), প্রিয়া ঘোষ (৪৪), রিয়া ঘোষ (৮৫), ডলি ঘোষ ( ১০৪), আপন ঘোষ (১০৫) ও লিলি ঘোষ (১৭২) নামে চেক বরাদ্দ করেছেন। যাদের কারোরই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে কোন যোগাযোগ নেই।
তালিকায় ২২ নম্বর ক্রমিকে অচলা মন্ডল নামে একজনকে সঙ্গীত শিল্পী দেখিয়ে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হলেও ওই নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। ওই নামের পাশে সাতক্ষিরার আবদুর রহমান নামে এক ব্যক্তির মোবাইল নম্বর যুক্ত করা হয়েছে যিনি কখনও মাগুরাতে আসেন নি বলে তিনি জানান।
তালিকায় ৫৮ নম্বর ক্রমিকে মাগুরার সঙ্গীত শিল্পী কবরি ঘোষের নাম রয়েছে। তার নামে ১০ হাজার টাকার চেক বরাদ্দ দেয়া হলেও তিনি কোনো প্রকার আর্থিক সহায়তা পাননি বলে তিনি জানান। তার নামে চেক ছাড় করানো হলেও তা থেকে কবরি ঘোষকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আবার আঞ্চলিক গানের জন্যে প্রখ্যাত মাগুরার কণ্ঠশিল্পী অনিল হাজারিকা অসহায় অবস্থায় বাড়িতে পড়ে থাকলেও তার মতো অনেকেই পাননি এই বরাদ্দের অর্থ।
এমননি ভাবে ওই গোষ্ঠি নামে-বেনামে ৪শত ৩৮ জনের নামে বরাদ্দকৃত ৪৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা ছাড় করিয়ে অধিকাংশ অর্থই নিজেরা আত্মসাথ করেছেন বলে মাগুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গণের অনেকেই অভিযোগ করেছেন।
এ বিষয়ে মাগুরা জেলা শিল্পকলা একাডেমি’র কালচারাল অফিসার জসিম উদ্দিন বলেন, আমি মাগুরাতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। এখানকার শিল্পীদের অনেককেই চিনি না। নাম সংগ্রহ করেছেন মাগুরা জেলা শিল্পকলা একাডেমির সদস্যরা। এখানে এরবেশি সংশ্লিষ্টতা আমার নেই।
অন্যদিকে মাগুরা শিল্পকলা একাডেমির সহ-সম্পাদক বিশ্বজিত নিজের স্বজনপ্রীতির কথা অস্বীকার করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের এই টাকা শিল্পীদের জন্যে বরাদ্দ থাকলেও সাউন্ড অপারেটর থেকে শুরু করে ডেকোরেটরের কর্মচারিরাও পেয়েছে। অনেকের কাছেই আবেদন করতে বলা হয়েছে। সবাই গুরুত্ব দেয়নি।
তবে মাগুরা জেলা প্রশাসক ডক্টর আশরাফুল আলম বলেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে তালিকা প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। ভূয়া কোনো ব্যক্তি যাতে এই অর্থ না পায় সেই চেষ্টা করেছি। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিষয়টি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।