জাহিদ রহমান : গরিব বা দরিদ্র শব্দটি কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু এই শব্দ দুটিই মাগুরাবাসীর কপালে ভালোভাবেই জুটেছে। বাংলাদেশের যে কয়টা জেলা উচ্চমাত্রার দারিদ্র্যপ্রবণ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে এর মধ্যে অন্যতম এখন মাগুরা।
দেশের জেলা ভিত্তিক দারিদ্রের মাপকাঠিতে মাগুরা অবস্থা চতুর্থ। মাগুরাতে দারিদ্রের হার ৫৬.৭ শতাংশ। জেলাওয়ারি বিচারে কুড়িগ্রামের স্থান সবার শীর্ষে। এই জেলার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ এখন দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। এরপরেই রয়েছে দিনাজপুর জেলা। এই জেলার দারিদ্রের হার ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এরপর রয়েছে বান্দরবান জেলা। এই জেলাতে দারিদ্রের হার ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ।
মাগুরাতে যে এত দরিদ্র মানুষের বসবাস মাগুরাবাসীদের হয়ত এসব আগে জানাই ছিল না। কিন্তু বিষয়টি গত বছরেই মূলত পত্রপত্রিকায় উঠে আসে এবং সেসময় এটি সবার দৃষ্টিগোচর হয়।
বর্তমান সরকারের গত ১২ বছরে (করোনাকালের আগে) যেখানে দ্রুতলয়ে সার্বিক দারিদ্রের হার কমে এসেছে সেখানে মাগুরাতে দারিদ্র্য আরও বেড়েছে! অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ আর নীতি-নির্ধারকদের কাছে মাগুরা এখন তাই এক গরিব জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো (বিবিএস) প্রথমবারের মতো জেলাওয়ারি দারিদ্রের হার জরিপ করে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে এই জরিপ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
এই জরিপে দেখা যায়, দেশের যে সাতটি জেলাতে অধের্কেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে তার মধ্যে মাগুরাও রয়েছে। জরিপে বলা হয় কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, বান্দরবান, মাগুরা, কিশোরগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, জামালপুর, এই সাতটি জেলাতে দারিদ্রের হার তুলনামূলক বিচারে সবচেয়ে বেশি। বিবিএস জরিপে শুধু মাগুরা জেলাতে দারিদ্রের বর্তমান হার ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ জেলার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে।
মাগুরাবাসী কেন এত গরিব? অথচ ভৌগলিক বিচারে এই জেলাতে যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন, বন্যা, খরা তেমন একটা নেই। আঞ্চলিক রোগব্যধি বলে কিছু নেই। সবমিলিয়ে সারাবছর ধরে মানুষগুলো এক ধরনের সুরক্ষার মধ্যেই বসবাস করে থাকে। কিন্তু তারপরেও অর্ধেকেরও বেশি মানুষ কেন গরিব এটি এক কঠিন প্রশ্ন মাগুরাবাসীর কাছে। যে সব সূচক দিয়ে বিবিএস ‘হাউসহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেনডিচার’ জরিপ করে সেই সূচক মতে, মাগুরাতে কর্মহীন লোকের সংখ্যা, অর্থাৎ বেকারত্মের হার অনেক বেশি। মানুষের গড় ইনকাম বা আয় কম। ফলে মানুষ পরিবারে বিভিন্ন ধরনের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা মেটানো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বস্ত্রখাতে প্রয়োজনীয় খরচ করতে পারে না। আর আয় কম হওয়ার কারণে ব্যয়ের সামর্থও অনেক কম।
এর আগে ২০১০ সালের জরিপে মাগুরার দারিদ্রের হার ছিল ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ। সে বছর বিবিএস জেলাওয়ারি দারিদ্র্য জরিপ না করলেও একটি প্রোভার্টি ম্যাপ তৈরি করেছিল। সেই প্রোভার্টি ম্যাপেও মাগুরার অবস্থান খুবই খারাপ ছিল। গত দশ বছরে অনেক জেলাতেই প্রচুর উন্নয়ন হলেও মাগুরাতে যে উন্নয়ন হয়নি এর বড় প্রমাণ হলো দারিদ্রের হার বেড়ে যাওয়া। অর্থাৎ ২০১০ সালে মাগুরা দারিদ্রের হার যেখানে ছিল ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এর অর্থ হলো মাগুরাতে দারিদ্রের হার কমেনি, গত দশ বছরে আরও বেড়েছে।
করোনাকালের আগে গত বছর জুনে সারাদেশে দারিদ্র্য হার নেমে এসেছিল সাড়ে ২০ শতাংশে। এর আগে ২০১০ সালে আমাদের সার্বিক দারিদ্রের হার ছিল ৩১ শতাংশ। সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণেই সার্বিক দারিদ্র্য কমে আসে। কিন্তু মাগুরাতে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। অর্থাৎ মাগুরা যে পুরোটাই উন্নয়ন বঞ্চিত হয়েছে তা পরিসংখ্যনই বলে দিচ্ছে। মাগুরা জেলা প্রশাসকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য মতে সর্বশেষ আদমশুমারী অনুযায়ী মাগুরার মোট জনসংখ্যা ৯ লক্ষ ১৩ হাজার। মাগুরার মোট আয়তন ১০৪৯ বর্গকিলোমিটার। আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যার ঘণত্ব ৮৭১ জন। মাগুরা মোট ৪টি উপজেলা, ১ টি পৌরসভা, ৩৬টি ইউনিয়ন এবং ৭৩০টি গ্রাম নিয়ে গঠিত।
গত দশ বছরে বেশিরভাগ জেলা দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলেও মাগুরা আরও পিছিয়েছে। জেলার দারিদ্র্য হার গত দশ বছরে অন্তত আর ১০ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সরকার থেকে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে এই জেলাতে বরাদ্দ না থাকার কারণেই দারিদ্র্য বেড়েছে। বিশেষ করে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ না থাকার কারণেই এমনটি হয়েছে। এটি সত্য যে গত বাজেটেও ( ২০১৯-২০২০) আমরা দেখেছি এডিপিতে মাগুরা জেলার জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ বা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। আর এখনতো করোনা দুর্যোগ মোকাবিলার সময়, বাজেটে জেলাখাতে বরাদ্দ সেভাবে দেওয়াই হয়নি।
মনে আছে গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ইনষ্টিটিউট অফ প্লানার্স ( বিআইপি) ‘জাতীয় বাজেটে আঞ্চলিক উন্নয়ন ভাবনা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অঞ্চল ভিত্তিক বরাদ্দের একটি তুলনামূলক চিত্র’ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে। সেই গবেষণায় দেখা যায়, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দপ্রাপ্ত জেলা হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জ। এবং সবচেয়ে কম বরাদ্দ প্রাপ্ত জেলা হলো মাগুরা, নড়াইল ও লক্ষীপুর।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তথা এডিপির মাত্র দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে এই জেলাগুলোর জন্য। মানে মোট উন্নয়ন বাজেট যদি হয় ১০০ টাকা তাহলে মাগুরাবাসীর কপালে জুটেছে মাত্র দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ টাকা।
উন্নয়নে মাগুরা কেন পিছিয়ে? এর প্রথম যে কারণ সেটি হলো মাগুরাতে আয়-কর্মসংস্থানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিল্প কলকারখানা সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আশির দশকের শুরুতে মাগুরার ভায়নাতে মাগুরা টেক্সটাইল মিল গড়ে উঠলেও পরবর্তীতে লোকসানে পড়ে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় চালু হলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই কারখানা কোনো প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়নি।
এদিকে মাগুরাতে মাঝারি বা ক্ষুদ্র ধরনের কলকারখানাও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এখন পর্যন্ত মাগুরাতে বিসিক শিল্পও গড়ে ওঠেনি। তবে কয়েকবছর হলো ব্যক্তি উদ্যোগে শ্রীপুরে সান অ্যাপারেলস গার্মেন্টস কারখানা চালু হওয়ার পর এক ধরনের অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মাগুরাতে এরকম আরও কলকারখানা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে।
করোনাকালের আগে মাগুরার দারিদ্র্যচিত্র যা ছিল তাতে করে এটি অনুমেয় যে এই চিত্র সামনে আরও ভয়াবহ রুপ নেবে। কারণ করোনার কারণে সারাদেশেই জীবন-জীবিকা থমকে গেছে। মাগুরার এখন যে দারিদ্র্যচিত্র এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের দুই সংসদ সদস্যকে গভীরভাবে ভাবার পাশাপাশি একটি উন্নয়ন পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে হবে। যদি সেটা না করা হয় তাহলে মাগুরার দারিদ্র্যচিত্র আরও দ্রুত বেড়ে যাবে।
আমি সম্মানিত দুই সংসদ সদস্যকে সবিনয়ে বলবো মাগুরাতে সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ যাতে বৃদ্ধি পায় সে বিষয়ে আরও উদ্যোগ গ্রহণ করতে। যাতে করে আগামী জরিপে আমরা দারিদ্রের এই কলংক থেকে বের হয়ে আসতে পারি।
মাগুরাবাসী জন্মগতভাবেই অনেকটা উদাসীন এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী। বহু আগে থেকেই এদের রক্তে আঞ্চলিকতা বা ইজম বলে কিছু নেই। হয়ত সে কারণেই ভেতরে ভেতরে যে মাগুরাবাসীর অনেক ক্ষয়ে গেছে সেটা হয়ত খেয়াল করেনি। পরিসংখ্যন বলে দিচ্ছে-মাগুরাতে দারিদ্রের হার অনেক বেশি।
জাহিদ রহমান: সম্পাদক, মাগুরা প্রতিদিন ডটকম।