আজ, রবিবার | ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | রাত ৪:২২

ব্রেকিং নিউজ :
বৃষ্টির প্রার্থনায় নামাজ পড়ে কাঁদলেন শ্রীপুরের মুসল্লিরা মহম্মদপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় শিক্ষকের মৃত্যু মাগুরায় প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ মাগুরায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন জাহিদুর রেজা চন্দন ও নবীব আলী মহম্মদপুরে চেয়ারম্যান পদে ৯ জন শালিখায় ৫ জনের মনোনয়ন পত্র জমা স্মৃতির আয়নায় প্রিয় শিক্ষক কাজী ফয়জুর রহমান স্মৃতির আয়নায় প্রিয় শিক্ষক কাজী ফয়জুর রহমান মাগুরা সদরে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ৭ শ্রীপুরে ৪ প্রার্থীর মনোনয়ন জমা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক কাজী ফয়জুর রহমানের ইন্তেকাল মাগুরার শ্রীপুরে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা!

৭ ডিসেম্বর মাগুরা হানাদারমুক্ত দিবস

আবু বাসার আখন্দ : ৭ ডিসেম্বর মাগুরা মুক্ত দিবস। একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশের আরো কিছু জেলার সাথে মাগুরাও হানাদার মুক্ত হয়। শত্রু মুক্ত হওয়ার আনন্দে এদিন সারা শহরে মুক্তিকামী মানুষের ঢল নামে।

‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা শহর। দিবসটি পালনে আওয়ামীলীগসহ জেলার বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবছরের মতো এবারো নানা উদ্যোগ নিলেও দিবসটি সরকারিভাবে পালনের দাবি জানিয়েছে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মাগুরা জেলার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মাগুরার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। ২ মার্চ শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে তত্কালীন কোর্ট চত্ত্বরে সামনে বটতলায় (বর্তমানে পুলিশ সুপারের কার্যালয়) তত্কালীন মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম আগুনঝরা বিপ্লবি বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যে মাগুরার মানুষের মাঝে ব্যাপক উদ্দিপনার সৃষ্টি হয়। এ সময় তাত্ক্ষণিকভাবেই ছাত্রলীগ সভাপতি মুন্সী রেজাউল ইসলামকে সভাপতি করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং অ্যাডভোকেট আছাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক এবং ওয়ালিউল ইসলামকে সদস্য সচিব করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। পরবর্তীতে এ দুটি পরিষদ গঠনের পর থেকেই তারা ঢাকার ঘোষণা অনুযায়ী মাগুরাতেও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে এবং ৩ মার্চ মাগুরায় সফল হরতাল পালন করে।

আহ্বায়ক অ্যাড.আছাদুজ্জামান সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম দুই উপদেষ্টা আতর আলী এবং অ্যাডভোকেট সোহরাব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এ অসহযোগ আন্দোলন অব্যহত রাখেন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গেরিলা তত্পরতা চালাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন আলতাফ হোসেন, এড.আবুল খায়ের, নবুয়ত মোল্যা, আবু নাসের বাবলু, নন্দ দুলাল বংশী প্রমুখ।

এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সারা দেশে হত্যযজ্ঞ শুরু করলেও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ২৬ মার্চ মাগুরার প্রবেশ পথ গুলোতে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে এক কঠিন প্রতিরোধ ব্যুহ তৈরী করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি তারা স্থানীয় ভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ, অস্ত্র ও সদস্য সংগ্রহ করতে থাকে।

১২ মার্চ তারা ঝিনাইদহ এসডিপিও মাহবুব এর সহযোগিতায় মাগুরা থানা লুট করে বেশ কয়েকটি অস্ত্র সংগ্রহ করে। ২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গা ইপিআর এর ৪ নং উইং কমান্ডার মেজর ওসমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ১ প্লাটুন সদস্যকে অস্ত্রসহ মাগুরার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগ দিতে প্রেরণ করেন যা পরবর্তীতে ব্যপক সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।

সংগ্রাম পরিষদ মাগুরা নোমানী ময়দানস্থ আনসার ক্যাম্পের টিনের ঘরটিকে তাদের প্রধান কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণেচ্ছু ছাত্র জনাতাকে সংঘটিত করে নোমানী ময়দান, পারনান্দুয়ালী শেখপাড়া আমবাগান, ওয়াপদা, সদর উপজেলার কাটাখালী ব্রিজের পাশে সহ বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় হাবিলদার সাজাহান, কামরুজ্জামান (শৈলকুপা), হারেসার, জাহিদুল ইসলাম মিটুল, আকবর হোসেন, জাহিদুল ইসলাম (বেলনগর), আঃ ওয়াহেদ মিয়া (পারনান্দুয়ালী), আবদুল মান্নান প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন।

৪ এপ্রিল তাজুদ্দিন আহম্মেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম মাগুরার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয় এবং ঐদিন রাতে সংগ্রাম পরিষদ তাদেরকে মাগুরা থেকে ভারতের পথে এগিয়ে দিয়ে আসে। এ দিনেই মাগুরা-যশোর সড়কের লেবু তলায় পাক বাহিনীর সাথে সুবেদার আঃ মুকিতের নেতৃত্বে মাগুরা সংগ্রাম পরিষদের ব্যপক সম্মুখ যুদ্ধের সৃষ্টি হয় যা ৭ এপ্রিল পর্যন্ত দফায় দফায় চলতে থাকে। এ যুদ্ধে শহরের পারনান্দুয়ালী গ্রামের শরিফুল ইসলাম ফুল সহ ১৫ জন নিহত হয়।

সংগ্রাম পরিষদ মাগুরায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা অব্যহত রাখলেও ২২ এপ্রিল সোমবার দুপুরে পাক সেনাবাহিনী বিশাল ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে ঝিনাইদহ ও যশোর সড়ক দিয়ে মাগুরা সীমানায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এদিন মাগুরার আলমখালী বাজার এলাকায় সুরেন বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তিকে পাক সেনারা গুলিতে নিহত করে এবং পরদিন ২৩শে এপ্রিল মঙ্গলবার জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়ায় পাক সেনাবাহিনী বাগবাড়িয়া গ্রামের লালু নামে এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে হানাদাররা শহরের পিটিআই, ভিটিআই, সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ) চত্ত্বর, মাগুরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নিউ কোর্ট বিল্ডিং, মাইক্রোওয়েভ স্টেশন ও মাগুরা সরকারি কলেজে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে।

শহরের মধুমতি ডাক বাংলোটিকে তারা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। পাক বাহিনী স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিত করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে তাদের যোগসাজসে নারকীয় হত্যাযজ্ঞসহ বর্বর হামলা আক্রমন চালিয়ে যেতে থাকে। মেজর হায়াত এবং মাগুরার রিজু, কবির, পীর ওবায়দুল্লাহ, বাশি চেয়ারম্যান ও আয়ুব চৌধুরীদের সেই সময়কার পৈচাশিক হত্যযজ্ঞ ও বিভিষিকার কথা মাগুরার মানুষের মনে এখনো জ্বলজ্বল করে।

যুদ্ধাকালিন সময়ে শ্রীপুরের আকবর বাহিনী, মহম্মদপুরের ইয়াকুব বাহিনী, মোহাম্মদপুর-ফরিদপুর অঞ্চলের মাশরুরুল হক সিদ্দিকীর কমল বাহিনী, মাগুরা শহরের খোন্দকার মাজেদ বাহিনী এবং মুজিব বিশেষ সাহসী ভুমিকা নিয়ে পাক সেনাদের ও স্থানীয় রাজাকার-আল বদর বাহিনীর সাথে প্রাণপন যুদ্ধ করে। এ সময় কমল বাহিনীর প্রধান মাশরুরুল হক সিদ্দিকী কমল ভাটিয়াপাড়ার এক সম্মুখ যুদ্ধে গুলিতে তার একটি চোখ হারান।

অপরদিকে আকবর হোসেন মিঞার শ্রীপুর বাহিনী রণাঙ্গণে একের পর এক বিরোচিত অভিযানে পাক হানাদার বাহিনীতে তটস্থ করে তোলে। শ্রীপুরের শ্রীকোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ বাহিনী মূলত মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর এলাকা জুড়ে তত্পরতা চালায়। এ বাহিনীর অব্যাহত অভিযান ও স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর তত্পরতায় পাক বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এ দুই বাহিনী ৬ ডিসেম্বর মাগুরাকে হানাদার মুক্ত করতে নিজনান্দুয়ালি গ্রামে ও বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্পে একই সময়ে আক্রমন চালায়। একই সাথে মিত্র বাহিনীর আগ্রাসনের ভয়ে পাকিস্তানি সেনারা রাতারাতি মাগুরা শহরে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরদিন ৭ ডিসেম্বর মাগুরা হয় শত্রুমুক্ত। মুক্তির আনন্দে সারা শহরে নামে হাজারো মানুষের ঢল।

মাগুরায় প্রতিবছরই ৭ ডিসেম্বরকে হানাদার মুক্ত দিবস ধরে বিশেষ উত্সাহ নিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ উপলক্ষে এ বছরও সকালে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শহরে বর্ণাঢ্য র‌্যালি, নোমানি ময়দানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন, আছাদুজ্জামান মিলনায়তনে আলোচনা এবং সন্ধ্যায় শহরে ব্লাক আউট ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলের আয়োজন করা হয়েছে। তবে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দিবসটি সরকারিভাবে পালনের দাবি জানিয়েছেন।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমাণ্ডরার আবদুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব। গৌরবময় সেই অর্জনের বিষয়টিকে মাথায় রেখে দিবসটি সরকারি ভাবে সারা জেলায় পালনের উদ্যোগ নেয়া হলে মুক্তিযুদ্ধকে আরো অধিক গুরুত্ব দেয়া সম্ভব হবে।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology