মাগুরা প্রতিদিন ডেস্ক : রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফলে অনেকটাই এলোমেলো বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার ব্যবস্থা। যুদ্ধ যেনো আমাদের ঘরে এসে হানা দিয়েছে। এখন যে সব পণ্য উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্চে তা কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল। অর্থনীতির নানা ম্যারপ্যাঁচে সাধারণ মানুষের পক্ষে এটি আঁচ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সত্য এটিই যে, আমাদের পণ্যবাজারের শান্তি কেড়ে নিয়েছে এই যুদ্ধ।
ইউক্রেনের কৃষকদের হাতে বর্তমানে ২০ মিলিয়ন টন শস্য আছে যেগুলো যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে আসতে পারছে না। অন্যদিকে দেশটিতে আবার নতুন ফসল কাটার সময় হয়েছে। বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইউক্রেন যেসব শস্য বড় আকারে রপ্তানি করে তার মধ্যে রয়েছে – সানফ্লাওয়ার অয়েল, ভুট্টা, গম এবং বার্লি। অন্যদিকে একই শস্য বিশ্ববাজারে বড় আকারে সরবরাহ করে রাশিয়া। কিন্তু যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য-শস্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর মানুষ এখন দিশেহারা।
বাংলাদেশের মানুষ ক্যালরির জন্য ভাতের উপর নির্ভরশীল। তবে আটা-ময়দা উপরও ধীরে ধীরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আর এই আটা-ময়দা আসে গম থেকে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর এর গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশে তার চাহিদার ৮০ শতাংশ গম আমদানি করে। এর অর্ধেক আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে। কিন্তু সে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবার কারণে গমের দাম বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশ আটা-ময়দার দামও বেড়েছে। সেই সাথে আটা-ময়দা দিয়ে তৈরি খাদ্যর দাম বেড়েছে বেশ খানিকটা।
বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের দাম এখন লাগামছাড়া। যদিও বাংলাদেশের বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের বেশিরভাগই আসে পাম অয়েল এবং সয়াবিন অয়েল থেকে। বিশ্বজুড়ে যেসব ভোজ্য তেল ব্যবহার হয় তার মধ্যে সানফ্লাওয়ার তেল প্রায় ১৩ শতাংশ। এর প্রায় ৭৫ শতাংশই আসে ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে। যেহেতু এই সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে, সেজন্য বিশ্বজুড়ে ভেজিটেবল অয়েলের চেইনের দাম বেড়ে গেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনিস্টিটিউট-এর গবেষণায় বলা হয়েছে বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় ভেজিটেবল অয়েল আমদানি করে হয় কাঁচামাল হিসেবে, নয়তো প্রক্রিয়াজাত পণ্য হিসেবে (পাম অয়েল এবং সয়াবিন অয়েল)। অথবা তেলবীজ আমদানি করে সেটিকে স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি করে। কিন্তু একদিকে করোনাভাইরাস মহামারি; পরবর্তীতে শ্রমিক সংকটে কারণে দাম কিছুটা উর্ধ্বমুখী ছিল। এর ঠিক পরপরই ইউক্রেন যুদ্ধ সে দাম আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ভুট্টা। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ১৬ শতাংশ ভুট্টা সরবরাহ করে। পৃথিবীর আরো অনেক দেশে ভুট্টা উৎপাদিত হয়। যেহেতু ইউক্রেন থেকে ভুট্টা সরবরাহ আসতে পারছে না সেজন্য বিশ্বজুড়ে পোল্ট্রি ফিড-এর দাম বেড়েছে। এর ফলে বাজারে মুরগী ও ডিমের দাম বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফিড ইন্ডাট্রিজ এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা দেবাশিষ নাগ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের ৬০ শতাংশ উপকরণ আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে ভুট্টা। ভুট্টার দাম অনেক বেড়ে গেছে। পোল্ট্রি ফিডের মূল উপাদানে মধ্যে ভুট্টা এবং সয়াবিন মিল (সয়াবিনের ভুষি) – এ দুটো হচ্ছে মূল উপাদান।
বিশ্ববাজারে সিংহভাগ সার রপ্তানির ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং বেলারুশের ভূমিকা রয়েছে। রাশিয়ার উপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেবার ফলে সেটি বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে সার আমদানি করে। সেটি ব্যাহত হলে ভিন্ন কোন উৎস দেখতে হবে। এতে করে খরচ বাড়বে কৃষি খাতে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানী তেলের দাম হু হু করে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানী তেলের আমদানি ব্যয় মেটাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটে জ্বালানী তেলের ভর্তুকির জন্য সরকারকে অনেক টাকা গুণতে হবে। অন্যথায় তেলের দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু তেলের দাম বাড়লে দ্রব্যমূল্য আরো বাড়বে।
বিষেকরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ব নতুন করে মন্দার মুখোমুখি হতে পারে। এই মন্দার আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। কারণ, রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্য রয়েছে। দেশ দুটিতে তৈরি পোশাক, পাটসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আবার গমসহ আরও বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়ে থাকে।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৪৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। একই সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। একইভাবে ইউক্রেনে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি রয়েছে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, তৈরি পোশাকের নতুন বড় বাজার রাশিয়া। ইউক্রেনেও কিছু পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। সরাসরি এই দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে পোশাক নেয়। আবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাধ্যমেও দেশ দুটিতে বাংলাদেশের পোশাক যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই সব দেশে পণ্য পাঠানোর জন্য জাহাজ পাওয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। ঝুঁকির কারণে কোনো জাহাজ এই অঞ্চলে ভিড়তে চাইবে না। ক্রেতারাও রপ্তানি আদেশের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। ফলে এই দুটি দেশে পোশাক রপ্তানি বিঘ্নিত হতে পারে।
সিটি গ্রুপে দেশের গম আমদানিকারকদের অন্যতম প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বাংলাদেশে গম আমদানি করা হয় রাশিয়া, ইউক্রেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ভারত থেকে। এরমধ্যে মোট আমদানির এক-তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। প্রতি বছর বাংলাদেশ প্রায় ৫০ লাখ টন গম আমদানি করে থাকে। এখন এই দুই দেশ থেকে লোড করার জন্য জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া এই দুই দেশের কারণে অন্যান্য দেশও সতর্ক। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলসংকটের আশঙ্কা থেকে ইন্দোনেশিয়া পামঅয়েল রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। কারণ, পামঅয়েল থেকে ইথানল তৈরি করে জ্বালানি চাহিদা মেটানো যায়। এক কথায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের পরিস্থিতি বৈশ্বিক বাণিজ্যকে বড়ভাবে প্রভাবিত করছে।
ইফাদ মাল্টি প্রডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন আহমেদ বলেন, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ খাদ্যদ্রব্যের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা হবে কিনা তা বলা মুশকিল। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনে যে ধরনের গম পাওয়া যায়, সে ধরনের গম অন্যান্য দেশে পাওয়া যায় না। ফলে এ দুটো দেশের পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হলে অন্যান্য দেশে সমস্যা হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। জ্বালানি তেল ও খাদ্যদ্রব্যের দামও বেড়েছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের পরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রচারিত হয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই দুটি দেশ খাদ্যশস্য ও পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় দেশ। দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়াতে আমদানিকারকরা বিকল্প দেশ থেকে পণ্য নিতে চেষ্টা করছেন। গম, ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেলের সরবরাহে এক ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সারা বিশ্ব যত গম রপ্তানি করে তার প্রায় ৩০ শতাংশ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এছাড়া ভুট্টার প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি হয় এই দুই দেশ থেকে। গম, ভুট্টা দিয়ে শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন হয়। সূর্যমুখী তেল রপ্তানির ৮০ শতাংশই করে এ দুই দেশ। ফলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলে চলতি মৌসুমে গম ও ভুট্টার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে এসব পণ্য থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বাড়বে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ভুট্টার দামও বেশ চড়া।